পাকি দোস্ত চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় !

NewsDetails_01

প্রয়াত চাকমা সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায়
যুদ্ধপরাধের অভিযোগ থাকায় রাঙামাটির সাবেক চাকমা সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায়ের নামে থাকা সব স্থাপনা থেকে ত্রিদিব রায়ের নাম ৯০ দিনের মধ্যে মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। আর এ ঘটনায় পাহাড় জুঁড়ে ফের আলোচনায় “পাকি দোস্ত” খ্যাত ত্রিদিব রায়ের নাম।
বিচারপতি রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে দেশের সকল স্থাপনা থেকে ত্রিদিব রায়ের নাম মুছে ফেলতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, শিক্ষা সচিব, পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও মেয়রকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
রবিবার (২১ মে) চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের নাম সকল স্থাপনা থেকে মুছে ফেলার নির্দেশনা চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা বদিউজ্জামান সওদাগর ও হেলাল উদ্দিন হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন।
স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ত্রিদিব রায়ের নামে সড়ক ও জায়গার নাম কেন রয়েছে এমন প্রশ্নের সহজ জবাব বেরিয়ে এলো স্থানীয়দের মুখ থেকে। তারা বলেন, গত বছরের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব স্থাপনা থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম মুছে ফেলার নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে ৬০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে শিক্ষা সচিব ও স্থানীয় সরকার সচিবকে নির্দেশ দেয়া হয়। ৬০ দিন পার হয়েছে বহু আগে কিন্তু রাজাকার ত্রিদিবের নামফলক তেমনি রয়েছে।
হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ দেশব্যাপী বেশ কয়েকটি স্থাপনা থেকে যুদ্ধাপরাধীদের নাম অপসারণ করেছে। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের নামে থাকা সড়ক ও জায়গার নাম পরিবর্তন করা হয়নি।
‘ত্রিদিব নগর ও ত্রিদিব সড়কের’ পুনঃনামকরণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে রাঙ্গামাটি শহরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন মানববন্ধন করে আসছে। পার্বত্য সমঅধিকার আন্দোলন, রাঙ্গামাটি পার্বত্য বাঙালী ছাত্রপরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা এ দাবি জানিয়ে আসছে। কয়েক দফা ডিসির কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিল।
১৯৭১ সালে ত্রিদিব রায়ের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী পাক দালাল হিসেবে চিহ্নিত এক আদিবাসী নেতার (রাজা ত্রিদিব রায়) সহযোগিতায় পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনী রাঙ্গামাটিতে এসে চুপিসারে অবস্থান নেয়। খবরটি মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ওত পেতে থাকা পাকি সৈনিকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ফেলে। এ দলে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাঙ্গামাটির আবদুল শুক্কুর, এস এম কামাল, শফিকুর রহমান, ইফতেখার, ইলিয়াস, অবদুল বারী, মোঃ মামুন ও আবুল কালাম আজাদ। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র আবুল কালাম আজাদ ও ফুড ইন্সপেক্টর আবদুল বারী ছাড়া অন্যদের পাকবাহিনী নির্মমভাবে অত্যাচার চালিয়ে মানিকছড়িতে নিয়ে হত্যা করে।
ত্রিদিব রায়ের সহযোগিতায় পাকিস্তানিরা পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রবসহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই হত্যা করেছে। ১৯৭১ সালের নবেম্বরে ত্রিদিব রায় পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তায় মিয়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান সরকার তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষ দূত হিসেবে ওই বছরই ব্যাংকক পাঠায়। জাতিসংঘের ১৯৭২ সালে জেনারেল এ্যাসেম্বলিতে বাংলাদেশের সদস্য পদ প্রদানের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হওয়ার পর পাকি সরকারের পক্ষে ত্রিদিব রায়কে প্রধান করে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রাজা ত্রিদিব রায়ের ভূমিকা যেমন জঘন্য তেমনি আরও কয়েক জনের ইতিহাস সুখকর নয়। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে রাঙ্গামাটি থেকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং বান্দরবান থেকে এ এস প্রু চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান এ্যাসেম্বলিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলি ইলেকশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত এই তিন জনপ্রতিনিধির কেউই মুক্তিকামী জনগণের পাশে দাঁড়াননি। ত্রিদিব রায় দেশের মুক্তিকামী জনতার পাশে না দাঁড়িয়ে যোগ দেন পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে। অন্যদিকে এ এস প্রু চৌধুরী যোগ দেন মালেক সরকারের মন্ত্রিসভায়। ত্রিদিব রায় তার প্রভাবাধীন হেডম্যান-কারবারিদের ব্যবহার করে চাকমা যুবকদের দলে দলে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করেন।
তাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়ে লেলিয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাকামী জনতার বিরুদ্ধে। এ সময় ত্রিদিব রায় ও তার রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একের পর এক হামলা পরিচালনা করে। এতে নির্মমভাবে শহীদ হন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। কয়েকটি অপারেশন ত্রিদিব রায়ের নেতৃত্বে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় তৎকালীন রাজাকার বাহিনী এবং তাদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে একাধিক হামলা ও হত্যাকান্ড চালানো হয়েছিল। সেই পাকি দোস্ত জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ নিয়ে কোন অনুতাপ স্বীকার করেনি। মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ব্যঙ্গ করে গেছেন। সেই রাজাকারের নামে এখনও সড়কের নামকরণ শোভা পাচ্ছে
পিতা ত্রিদিব রায়ের সাথে বর্তমান চাকমা সার্কেল চিফ রাজা দেবাশীষ রায়
পাকিস্তানের মন্ত্রী ও বিশেষ দূত রাজাকার ত্রিদিব রায়
১৯৭০ এর দশকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর মন্ত্রিসভায় ত্রিদিব রায় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি পাকিস্তান সরকারের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের বিশেষ দূত নিযুক্ত হয়ে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গঠনে পৃথিবীর বৌদ্ধপ্রধান রাষ্ট্রগুলো চষে বেড়ান। স্বাধীনতার পর ত্রিদিব রায় আর দেশে ফিরে আসেননি। পরে পাকিস্তান সরকার তাকে সে দেশের দফতরবিহীন ফেডারেল মন্ত্রীর মর্যাদা দেয়। যা তাকে ‘উজিরে খামাখা’ হিসেবে পরিচিত করে তোলে।
রাষ্ট্রদূত ত্রিদিব রায়
১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ত্রিদিব রায় বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আর্জেন্টিনা, শ্রীলঙ্কা, চিলি, ইকুয়েডর, পেরু ও উরুগুয়ের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
এম্বেসেডর এট লার্জ‌
১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিদেশে অবস্থান করার পর তিনি চূড়ান্তভাবে পাকিস্তান ফিরে আসেন। এরপর থেকে তিনি সেদেশের এম্বেসেডর এট লার্জ‌ ছিলেন।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির প্রস্তাব
ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার আবেদন করেছিলেন। তবে ত্রিদিব রায় তা ফিরিয়ে দেন। কারণ পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী একজন মুসলিম শুধু রাষ্ট্রপতি হতে পারেন। কিন্তু ত্রিদিব রায় ছিলেন একজন বৌদ্ধ এবং তিনি ইসলাম গ্রহণে ইচ্ছুক ছিলেন না।
উল্লেখ্য, ১৯৩৩ সালের ১৪ মে রাজা ত্রিদিব রায় চাকমা রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত চাকমা সার্কেল চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৭৭ সালে তার অনুপস্থিতিতেই তার ছেলে বর্তমান সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায় রাজার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
ত্রিদিব রায় ১৯৩৩ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে চাকমা রাজপ্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি রাজা নলিনাক্ষ রায় ও তার স্ত্রী বিনিতা রায়ের ছেলে। ১৯৫৩ সালের ২ মে ত্রিদিব রায় চাকমা সার্কেলের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন। ১৯৭১ সালে তিনি দায়িত্ব ত্যাগ করেন। এরপর তার ছেলে দেবাশীষ রায় রাজা হন।
ছয়দফা দাবির বিরোধীতা
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। ত্রিদিব রায় এই কর্মসূচির সমর্থক ছিলেন না। সেসময় তিনি বিভিন্নভাবে ছয় দফার বিরোধীতা করেন।
১৯৭০ এর নির্বাচন আওয়ামীলীগ বিরোধী এমপি

আরও পড়ুন