আকাঙ্ক্ষার ফানুস উড়লো আকাশে

NewsDetails_01

fanush2রাঙামাটি সদরের শুকরছড়ি গ্রামের নয়ন কিশোর চাকমা। তাঁর ১০ বছরের কন্যা ডিম্পোর আজ জন্মদিন। জন্মদিনে সারাদিন সে হৈ-হুল্লোড় করে কাটাচ্ছে। নয়ন কিশোর চাকমা একজন কার্বারি। গ্রামের লোকের সুখদুঃখে তাদের পাশে থাকতে হয়। তাই মেয়ের জন্মদিনেও তিনি গ্রামের মুরুব্বীদের দাওয়াত দিলেন দুপুরের খাবার খেতে। সকলেই দুপুরের খাবার শেষ করলো। এখন ডিম্পোর অপেক্ষা সন্ধ্যায় সকলে মিলে ফানুস উড়ানোর জন্য। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে ডিম্পোসহ পরিবারের সকলেই উঠোনে জড়ো হলো ফানুস উড়াতে। গ্রামের জয় লাল চাকমা ফানুস তৈরি করে দিয়ে গেলেন। সন্ধ্যায় সেসব ফানুসে সকলে মিলে আগুন দিলো। মুহূর্তেই ফানুস উড়ে গেলো দূর আকাশে। যতই উপরে উঠছে যেনো মনে হচ্ছে রাতের আকাশে আরেকটি তারা যোগ হচ্ছে। মনের সমস্ত মলিনতা দূর করে আলোর বর্তিকা নিয়ে যেনো ফানুস উড়ে চলেছে উদার পানে। আকাঙ্ক্ষার ফানুস উড়লো আকাশে।

মঙ্গল কামনায় ফানুস উড়ানো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি ঐতিহ্য। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের যেকোনো ধর্মীয় বা মঙ্গল কাজে ফানুস উড়ানো হয়। এটা যতই না ধর্মীয় রীতি তার চাইতে বেশি ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যকে দীর্ঘদিন ধরে তারা লালন পালন করে আসছে। আগে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ফানুস উড়ানো হলেও এখন যেকোনো উপলক্ষতে মঙ্গল কামনায় ফানুস উড়ানো হয়।

কিভাবে ফানুস তৈরি হয়ঃ

ফানুস তৈরির কারিগর গ্রামের জয় লাল চাকমা জানান, ফানুস তৈরি করতে কাঁচা বাঁশ, রঙ্গিন কাগজ, গাম, রশি ও মাটিয়া তৈল লাগে। প্রথমে বাঁশকে চিকন করে কেটে গোলাকার চাকতি তৈরি করতে হয়। ফানুসের সাইজ অনুযায়ী চাকতির সাইজ নির্ধারণ হবে। রঙ্গিন কাগজকে গোল করে ফানুসের সাইজ অনুযায়ী তৈরি করতে হবে। এরপর গোলাকার রঙ্গিন কাগজের উপরের অংশ আরেকটি রঙ্গিন কাগজ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। বাঁশের চাকতি নিচের অংশে রঙ্গিন কাগজের সাথে আটকিয়ে দিতে হবে। এরপর বাঁশের চাকতিকে চারদিক থেকে তার দিয়ে টানা দিতে হবে। যেনো টানা তারে মাঝখানে রশির বুদ্দি(সলতা) বেঁধে দিতে পারে। সে বুদ্দিতে মাটিয়া তৈল ঢেলে দিতে হবে। পরে বুদ্দিতে আগুন দিলে তাঁর ধোঁয়া রঙ্গিন কাগজের আবৃত অংশ অর্থাৎ ফানুসে ঢুকে উপরে দিকে ঠেলে দিবে। সাইজ অনুযায়ী ফানুস অনেক উপরে যেতে পারে। বড় ফানুস মাটির থেকে কয়েক হাজার ফুট উপরে উঠতে পারে। বুদ্দিতে যতক্ষণ আগুন থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত ফানুস উড়তে থাকবে। এক পর্যায়ে আগুন নিভে গেলে ফানুস আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসে।

ফানুস কেনো উড়ানো হয়ঃ

NewsDetails_03

fanushসাধারণত মঙ্গল কামনায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ফানুস উড়িয়ে থাকে। অনেক সময় মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তি কামনায় ফানুস উড়ানো হয়। এছাড়া শুভ কাজেও ফানুস উড়িয়ে থাকে পাহাড়ের মানুষ। তাদের বিশ্বাস, ফানুস সমস্ত অন্ধকার দূরীভূত করে আলো জ্বালাবে পৃথিবীর বুকে। সামান্য আলোয় একটা ফানুসকে যতদূর উপরে তুলতে পারে; ঠিক তেমনি মানুষের মনেও একটু আলো তাকেও অনেক দূরে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

ফানুস কখন উড়ানা হয়ঃ

পূর্ণিমা তিথিতে বিশেষ করে বুদ্ধ পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, বনভান্তের জন্মদিন ও পরিনির্বাণের দিনসহ পাহাড়ের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা(এমএন লারমা)’র জন্মদিন ও মৃত্যুবার্ষিকীতেও মঙ্গল কামনায় ফানুস উড়ানো হয়। এছাড়া বৈসাবি, ফসল তোলার দিনেও ফানুস উড়ানো হয়। যেকোনো শুভ কাজে ফানুস উড়ায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। বিহারগুলোতে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও ফানুস উড়ানো হয়।

বিপত্তিও ঘটে মাঝে মাঝেঃ

ফানুস উড়ানো পাহাড়ের মানুষের কাছে একটি ঐতিহ্য ও তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতির অঙ্গ। একসময় তারা বিশ্বাস করতো ফানুস আকাশে উড়লে সেগুলো ঘরবাড়ির ওপর পড়বে না। কিন্তু, বর্তমানে পাহাড়ে ঘনবসতি বৃদ্ধি পাওয়ায় হরহামেশায় ফানুস ঘরবাড়ির ছাদের এসে পড়ে। অনেক সময় আগুনে ঘরবাড়িও নষ্ট হয়। ২০১০সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মৃত্যুবার্ষিকীতে ফানুস উড়ানো হলে তার আগুন রাঙামাটির ঐতিহ্যবাহী চাকমা সার্কেল চিফ রাজবাড়ীর ওপর এসে পড়ে। এতে অনেক বছরের ঐতিহ্য রাজবাড়ী আগুনে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। তবে হাজারো ফানুসের মধ্যে এরকম দুর্ঘটনা খুবই কম।

ডিম্পো এবার তার ১০ বছরের জন্মদিন উপভোগ করলো দশটি ফানুস উড়িয়ে। দিনের সমস্ত আনন্দ যেনো তার কাছে আসলো ফানুস উড়ানোর মধ্য দিয়ে। শেষ ফানুস উড়ানোর পর সে চিৎকার করে উঠলো ‘আগামীবার এগারোটা উড়াবো’। এভাবেই ফানুস উড়ানোর সংস্কৃতি ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে উত্তরসূরীরা।

আরও পড়ুন