পাহাড়ের বৈসাবি উৎসব থেকে শেখার আছে অনেক কিছু

NewsDetails_01

বৈসাবি উৎসব
বৈচিত্রপূর্ণ পাহাড়ের নববর্ষ উৎসব। কেউ বলে বিঝু, কেউ বলে সাংগ্রাই, কেউ বলে বিহুু আবার কেউবা বৈসুক। তাই অনেকে একত্রে “বৈসাবি” বলতে সাচ্ছন্দবোধ করেন। নববর্ষ এলে পাহাড়ের প্রাণ ফিরে পায়। চারিদিকে নানা আয়োজন, রঙ-বেরঙ এর পোষাক, নানা ভাষার (প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর রয়েছে আলাদা আলাদা ভাষা) পাশাপাশি সমতল থেকেও প্রচুর পর্যটকের সমাগম ঘটে। পাহাড়ের লোকজন এই দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকেন দলে দলে বিভক্ত হয়ে র‌্যালি বের হওয়ার জন্য। র‌্যালি বের করে মূলত তারা আনন্দ প্রকাশ করতে চায়। ভালবাসা, সহভাগিতা, সহমর্মিতা জানাতে চায়।
পাহাড়ে এমনিতেই আন্তঃ জনগোষ্ঠীর (ত্রিপুরা, চাকমা, মারমাসহ অন্যান্য সকল) মধ্যে এই যাবতকালের কোন দ্ব›দ্ব নেই। তাদের মধ্যে পোষাক ভিন্ন হতে পারে, ভাষা ভিন্ন হতে পারে কিন্তু যুগ যুগ ধরে একই অঞ্চলে একত্রে বসবাস করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে গভীর বন্ধন তৈরী করেছে। যে বন্ধন তাদেরকে ভাষায়, পোষাকে এমনকি ধর্মীয় বিশ্বাসে ভিন্নতা থাকলেও আলাদা ভাবতে শেখায়নি।
এই তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় ১৩টি ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ বসবাস, অনেক জনগোষ্ঠীর জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। তাদের এই একত্রে বসবাস যা সামরিক শাসনামলে চক্ষুশূল হিসেবে দেখা দেয়। সম্প্রদায় ভিত্তিক সংগঠন করে (মারমা উন্নয়ন সংসদ, ত্রিপুরা উন্নয়ন সংসদ) বিভাজনের চেষ্টা করা হয় কিন্তু আশানুরুপ সুবিধা লাভ করতে পারেনি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধুমাত্র আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বদ্ব, প্রতিহিংসা আর একে অপরকে হত্যা ব্যতিত আন্তঃ জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোন ধরনের দৃশ্যমান দ্বদ্ব লক্ষ্য করা যায় না।

পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী এই জনগোষ্ঠীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক অভিন্নতা, জীবনধারণ পদ্ধতি এবং বঞ্চনার ধরন একই হওয়ার কারনেই মুলত এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করেছে প্রাকৃতিকগত ভাবে। এই জনগোষ্ঠীদের মধ্যে কমবেশী অনেকে এখনো জুমচাষের উপর নির্ভরশীল। আবার যারা এখন বিভিন্ন কারণে জুমচাষ আর করছেন না তারাও কিন্তু জুমের ফসলের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। জুমের কোন ফলন বাজারে এলে সবার চেষ্টা থাকে আগে আগে সংগ্রহ করার। আমরা যারা এই পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করি, জুমের চাল আর জুমে উৎপাদিত কোন ধরনের ফল মুখে পড়লে বুঝতে পারি। আমরা সহজে পাথর্ক্য নিরুপন করতে পারি জুম আর লাঙ্গল চাষের ফলনের স্বাদ ও গন্ধ দিয়ে।
তাইতো পার্বত্য অঞ্চলের নাচ-গান আর গল্পসব জুম কেন্দ্রিক। জুমকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্রেম কাহিনীসহ নানা হাসি কান্নার গল্প। অনেক অনেক নাটক মঞ্চস্ত হয়েছে এই জুমকে নিয়ে। আর তাইতো জুমকে কেউ জেনে বা, না জেনে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন (জুম বন বিনাশ করে, পরিবেশ বান্ধব নয় ইত্যাদি) করলে পাহাড়ের সাধারণ জুমিয়া থেকে শুরু করে এই অঞ্চলের গণমান্য বক্তিবর্গরাও নড়েচড়ে বসেন। ফলে জুম পার্বত্য অঞ্চলের লোকজনদের একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছে। তাদের নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সহ এনজিও গুলোর লোগোতে জুমের ছবি ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।
জুমের ফলন না হলে এখনও অনেক উপজেলায় প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে নিরবে দুঃর্ভিক্ষ হয়। নিরবে দেশান্তরিত হয়, যা আমরা অনেকে জানি না। যার পরিপ্রেক্ষিতে পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জুমচাষীদের এই নববর্ষে একটি প্রধান চাওয়া থাকবে, জুমের ফলন যেন ভাল হয়। যাতে সারা বছরটা মোটামুটিভাবে কেটে যায়।

বৈসাবি উৎসব
অন্যদিকে পার্বত্য জেলা শহরের পাহাড়ী বাবুরা জুমকে নিয়ে নাচ, গান আর কবিতা আবৃতি করবে। জুমের নানা ফলন সংগ্রহ করে বছরের সেরা তরকারি পাচন রান্না করে প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন আর গণ্যমান্যদের খাওয়ানোর চেষ্টা করবে। যাতে আগামী বছরটা সুন্দর কাটে, রোগমুক্ত থাকে।
যারা রাজধানী সহ দেশের অন্যান্য শহরগুলোতে বসবাস করার কারনে গ্রামে যেতে পারবে না তারাও এই জুমের ফসলাদি সংগ্রহ করে পাচন রান্না করতে চাইবে। সবাই যে যার মতো করে চেষ্টায় থাকবে পাচনের উপকরনাদি বাড়াতে। গ্রামে গ্রামে প্রতিবেশী নারীদের মাঝে পাচন উপকরনাদি বিনিময় হবে। চেষ্টা করবে সবাই সবাইকে খুশি করাতে যতটুকু বাড়ীতে বেড়ানো সম্ভব বেড়াতে।
স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পরিকল্পনা থাকবে নতুন কোন গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার, যে গ্রামগুলোতে তাদের আগে কখনো যাওয়া হয়নি।
গ্রামের বয়স্ব বুড়ো বুড়িরা এই নববর্ষকে ঘিরে নানা আয়োজনের সামনে পিছনে থেকে নির্দেশনা দিয়ে আরো আকর্ষনীয় করার পাশাপাশি কারিগরী জ্ঞানের প্রজম্ম ভিত্তিক সুন্দর হস্তান্তরের চেষ্টা করবে। গ্রামের মুরুব্বিদের সব সময় চিন্তা থাকে তাদের অভিজ্ঞতায় অর্জিত জ্ঞান যাতে নতুন প্রজম্মরা ধারণ এবং পালন করে, সেই চেষ্টা করার।
মন্দিরে মন্দিরে নিজেদের গ্রাম, সমাজ আর দেশের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা সভা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জুঁড়ে হাজার হাজার মোমবতি প্রজ্জলন করা হবে আগামীর মঙ্গলের জন্য, শান্তির জন্য, সমাজে সমাজে, মানুষে মানুষে ভালবাসার জন্য। ফানুস উড়ানো হবে রাতের পার্বত্য আকাশের কাল মেঘ কেটে আগামীতে যাতে আলোয় আলোয় ভরে উঠে।

সারা দেশের পত্র পত্রিকা জুঁড়ে রঙিন ছবি সম্বলিত নানা প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। যেখানে অধিকাংশ পত্রিকা বলবে পাহাড়ে আনন্দ উৎসব বৈসাবি উৎযাপিত হচ্ছে ইত্যাদি। পত্রিকায় আগাম প্রতিবেদন আর পূর্ব থেকে জানাশুনার সুবাদে হাজার হাজার পর্যটক পার্বত্যমুখি হবে। যাদের অধিকাংশই উদ্দেশ্য হবে ছবি তোলা আর সোজাসাপটা আনন্দ করা।

NewsDetails_03

আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, হাজার হাজার পর্যটকদের মধ্যে খুব কমই পাহাড়ের এই জনগোষ্ঠীদের বৈচিত্রপূর্ণ বৈসাবি উৎসবের তাৎপর্যতা অনুধাবনে সক্ষম হবেন। তারা এই জনগোষ্ঠীদের উৎসবকে অন্য দশটি উৎসবের মতোই ধরে নিয়ে আনন্দ করবে, ঘুরে বেড়াবে, ছবি তোলে ফেসবুকে পোষ্ট করবে মাত্র। এই সাধারণ পর্যটকদের পাশাপাশি দেশের নানা বিভাগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ী ছাত্রছাত্রীরা সমতলের বসবাসকারী বন্ধুদের নিয়ে যাবেন পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে। পাহাড়ের সংস্কৃতি দেখাতে। এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের ছাত্রছাত্রীরাও বৈসাবির মূলমন্ত্র উপলদ্ধি করতে পারবে কিনা জানি না। তবে আমাদের সকলের প্রয়োজনে, বর্তমান বিশ্বের এই সংঘাতপূর্ণ সমাজে এই ডজন খানেক জনগোষ্ঠী কি করে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে তা উপলব্ধি করা দরকার।
এই উৎসব অন্য দশটি উৎসবের মতো নয়। এই উৎসব মানে শুধু মানুষে মানুষে ভালবাসা বিনিময় নয়, শুধু গতানুগতিক মানুষের মঙ্গল কামনা করা নয় বরং এইসবের পাশাপাশি বৈসাবি হলো প্রকৃতি, নদী আর পাহাড়কেও কৃতজ্ঞতা জানানো। তাইতো এই দিনে তারা নদীকে পূজা করে ফুল দিয়ে (জীবনে নদনদীর গুরুত্ব অনুধাবনের কথা বলে), বড় বড় গাছপালাকে পূঁজা (যত্ন করার শিক্ষা দেয়) করে, প্রকৃতির থেকে সহজলভ্য উপকরনাদি দিয়েই তারা বছরের সেরা তরকারি রান্না করে (প্রকৃতি প্রদত্ত পাঁচ মিশালি খাবারের ঔষধি গুনের কথা বলা হয়)।
বর্তমান পৃথিবীতে দ্ব›দ্ব, সংঘাত আর প্রতিহিংসার সংস্কৃতিতে শান্তিপূর্ণ বসবাসের একটি প্রকৃত উদাহরণ হতে পারে এই বৈসাবি। এই বৈসাবি শুধু মানুষে মানুষে বন্ধন তৈরী করে না, আগামীর পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য করে রাখতে আমাদের উৎসব কেমন হতে পারে তারও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে।

বৈসাবি মানে শুধু পাহাড়ীদের মধ্যেই বন্ধন নয়। সেখানে আগে থেকে বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষী বাঙালী সম্প্রদায়ের সহিত পাহাড়ী জনগোষ্ঠীদের রয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক। কারন তারাও একসাথে বসবাস করতে গিয়ে একে অপরকে চিনে, জানে এবং সম্মার্ন করে। দেশের বৃহত্তম বড় ঈদ থেকে শুরু করে হিন্দুদের দুর্গা পূঁজা সবখানে পাহাড়ীদের সবর উপস্থিতি দেখা যায়। পাহাড়ের খুব কম পূঁজা মন্ডপ জমবে যদি সেখানে পাহাড়ীদের নিত্যদিন ঢল না নামে। এইবারের বৈসাবিও সকল সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য উম্মুক্ত থাকবে। সকলে পাহাড়ীদের বাড়িতে বেড়াবে। এটাই হলো বৈসাবির মূল সৌন্দর্য।

কিন্তু পাহাড়ের এই জনগোষ্ঠীদের নানা নামে পরিচয় দিয়ে (যেমন কখনো উপজাতি, কখনো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইত্যাদি) রাষ্ট্র শুধু তাদের নানাভাবে ‘ছোট’ করেই চলেছে (দেখুন ত্রিপুরা ৫ আগস্ট ১৩)। তারা যা করছে সবকিছুতে সন্দেহ করা হয়। এনজিও কার্যক্রমে সন্দেহ হয়। তাই পার্বত্য এনজিও গুলোকে সময়ে সময়ে বিভিন্ন সরকারি অফিস থেকে বিভিন্ন ধরনের ফরম দিয়ে তথ্য যাচাই করা হয় যেমন, সুবিধাভোগী এবং কর্মীদের মধ্যে কতজন পাহাড়ী আর কতজন বাঙালী ইত্যাদি। তাদের জীবনধারনের উৎস জুমচাষেও সন্দেহ হয় (দেখুন ত্রিপুরা, নভেম্বর ২০০৩)। তারা একত্রে মিলেমিশে দ্ব›দ্বহীনভাবে বসবাস করতে জানে তাতেও রাস্ট্রের মাথাব্যাথা। তাই তাদের ভাগ করতে চায়। তাদের দিয়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে সংগঠন করানো হয় যাতে দ্বদ্ব তৈরী হয় (দেখুন এন, মং ১৬)। সমতলের নানা কারনে সমালোচিত সরকারি কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের পোষ্টিং করানো হয় এই পাহাড়ী অঞ্চলে (দেখুন ত্রিপুরা,৪ জুন, ২০১৬ ও নাসরিন১, জুন,২০১৬)। পাহাড়ী জনগোষ্ঠীদের নিয়ে নানা গুজব ছড়িয়ে নানা সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত রাখার চেষ্টা করা হয় (পার্বত্য চট্টগ্রাম মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় আসে ২৭ মার্চ ২০০৮ সালে, দেখুন ২৮ মার্চ ২০০৮। (the daily star)।
তবে আশার কথা হলো দেরীতে হলেও সরকার এই বৈসাবির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে। তাইতো ১৩ এপ্রিল ২০১৫ সালে এই উৎসবের জন্য পাহাড়ী কর্মচারী আর কর্মকর্তাদের জন্য ঐচ্ছিক ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অনেক বাঁধা বিপত্তির পরও পাহাড়ের এই জনগোষ্ঠীরা একত্রে মিলেমিশে বসবাস করছে। অনেকের ধর্ম ভিন্ন হয়েও কিভাবে একত্রে বসবাস করতে পারে, তা পার্বত্য সমাজ থেকে দেশ ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের শেখার অনেক রয়েছে।

তথ্যসূত্র:
১) প্রশান্ত ত্রিপুরা, অস্তিত্বের জমিন যখন লুটেরাদের দখলে, ৫ আগস্ট ২০১৩, bdnews24.com
২) প্রশান্ত ত্রিপুরা, বন্ধ হোক হিল-খাটানোর বর্ণবাদী চিন্তা ও অপচর্চা, ৪জুন, ২০১৬, bdnews24.com
৩) প্রশান্ত ত্রিপুরা ও অবন্তী হারুন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুমচাষ, নভেম্বর ২০০৩,সেড, ঢাকা।
৪) জোবাইদা নাসরিন, পার্বত্য চট্টগ্রাম কি ‘পানিশমেন্ট জোন’?, প্রথম আলো, ১৬ জুন, ২০১৬।
৫) জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় বিধি-৪ শাখা কর্তৃক প্রজ্ঞাপন, স্মারক-০৫.০০.০০০০.১৭৩.০৮.০০১.১৫-৮৫, ১৩ এপ্রিল, ২০১৫।
৬) থানচিতে খাদ্য সংকট সম্পর্কিত সংবাদ প্রতিবেদন দেখুন, বিবিসি বাংলা (২ মে ২০১৬), ভোরের কাগজ (২৭,৫,২০১৬), সমকাল
(২৬ মে, ২০১৬), বণিক র্বাতা (০২ জুন, ২০১৬)।
৭) Nyohla Mong, Composite Heritage and its Importance for the Indigenous Peoples of Chittagong Hill Tracts of
Bangladesh, South Asian Composite Heritage (SACH), New Delhi, May-July, Volume-1, Issue-43, 2016

লেখক: উন্নয়নকর্মী ও ইউএন ইনডিজেনাস ফেলো। ইমেইল: [email protected]

আরও পড়ুন