দুধেও ভেজাল শিশু খাবে কী

NewsDetails_01

‘আমার মেয়ে একদম বাড়ছে না। নিয়মিত দুধ (গরু) খাওয়াচ্ছি, তারপরও। সব সময় অসুখ লেগেই থাকে। মাঝে মধ্যেই বমি করে।’
‘আমার ছেলের ওজন বাড়ছে না, কী করি বলেন তো?’ পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার আলো বললেন, এ প্রশ্নগুলো আমরা খুব নিয়মিতই শুনছি। দুধে যদি ভেজাল থাকে, তা শিশুর কী কাজে লাগবে!

শিশু, যুবা কিংবা বয়োবৃদ্ধ- প্রত্যেকের খাবারের পরিপূরক সুষম খাদ্য হল দুধ। তা হওয়া চাই খাঁটি ও বিভিন্ন রাসায়নিকমুক্ত। কিন্তু হালে খামারির কাছ থেকে গ্রাহকের কাছে পৌঁছা পর্যন্ত পদে পদে ভেজাল হচ্ছে দুধ।

এমনকি বিভিন্ন রাসায়নিক মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে তা। আর যেখানে খাঁটি দুধ মিলছে, সেখানে দেখা গেছে- রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক ও সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি রাসায়নিক।
সম্প্রতি একটি গবেষণা ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের কয়েকটি অভিযানে এ চিত্র উঠে আসায় এ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে আরও। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাজার থেকে দুধ সংগ্রহ করে নমুনা পরীক্ষার পর ব্যবস্থা নিতে ও বিস্তারিত জানাতে বলেছেন। কিন্তু এখনও চিত্র বদলায়নি।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আর্থিক সহায়তায় জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগার (এনএফএসএল) বাজার থেকে কাঁচা তরল দুধের ৯৬টি নমুনা সংগ্রহ করে সম্প্রতি গবেষণা চালিয়েছে। এতে তারা দেখেছে নমুনার সবগুলোতেই সিসা ও অ্যান্টিবায়োটিক অনুজীব রয়েছে। প্যাকেটজাত দুধের ৩১ নমুনার মধ্যে ১৮টিতেই ভেজাল রয়েছে। এছাড়া ছিল উচ্চমাত্রার বিভিন্ন রাসায়নিক।

এনএফএসএলের প্রতিবেদনে বলা হয়, গরুর দুধের ৯৬টি নমুনার মধ্যে ৯ শতাংশ দুধে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক, ১৩ শতাংশে টেট্রাসাইক্লিন, ১৫ শতাংশে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি সিসা পাওয়া যায়।

সেই সঙ্গে ৯৬ শতাংশ দুধে পাওয়া যায় বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া। প্যাকেটের দুধের ৩১টি নমুনার ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি হারে টেট্রাসাইক্লিন মেলে।
৬৬ থেকে ৮০ শতাংশ দুধের নমুনায় বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া পাওয়ার কথা বলা হয় প্রতিবেদনে। এছাড়া দইয়ের ৩৩টি নমুনা পরীক্ষা করে একটিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি সিসা এবং ৫১ শতাংশ নমুনায় পাওয়া যায় বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া।

ওই প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করা হলে আদালত সারা দেশের বাজারে কোন কোন কোম্পানির দুধ রয়েছে এবং দুধ ও দুধজাত খাদ্যপণ্যে কী পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক ও সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি সিসা পাওয়া গেছে তা নিরূপণ করে তালিকা দেয়ার নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কী আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে- সে প্রতিবেদন দিতে বলেন।

NewsDetails_03

পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার ও আশপাশের এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, দক্ষিণের জেলাগুলো থেকে ট্রাকে ট্রাকে দুধ আসছে সেখানে। তা রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। এ দুধ ‘খাঁটি’ কিনা জানতে চাইলে এক আড়তদার যুগান্তরকে বলেন, ‘জানি না। দুধ সংগ্রহ বা আনার সময় আমাদের কোনো প্রতিনিধি থাকে না। তবে বছরের পর বছর ধরেই আমরা এ দুধ বাসাবাড়ি ও মিষ্টির দোকানে বিক্রি করছি।’

এক ব্যবসায়ী জানান, গাভি থেকে দোহনের ১ থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দুধ রাখার নিয়ম। তা আমরা করতে পারি না। দুধ সংগ্রহ থেকে লক্ষ্মীবাজারে আনতেই লেগে যায় ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা। দুধ ঠিক রাখতেই তখন পানি মেশাতে হয়। আরেক ব্যবসায়ী জানান, দুধে ভেজাল থাকার কারণে অনেক ব্যবসায়ী এ ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। এক আড়তদার বলেন, রাজধানীতে আসা অনেক দুধ নদী পথেও আসে। পাত্রে কচুরিপানা দিয়ে এসব দুধ আনা হয়। এছাড়া ময়লাও পাওয়া যায়। এসব দুধ তৈরি করা কিনা তাও জানেন না তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানী কিংবা বিভাগীয় শহরগুলোই নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও ভেজাল দেয়া হচ্ছে দুধে। শুধু পানি মেশানো নয়, তৈরি করা হচ্ছে নকল দুধও। কোথাও কোথাও দুধ থেকে যন্ত্র দিয়ে ছানা বের করে নেয়ার পর, পড়ে থাকা পানিতে মেশানো হচ্ছে কস্টিক সোডা, ইথাইল অ্যালকোহল, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ও সামান্য গুঁড়োদুধ। মেশানো হচ্ছে সোডা, সোডিয়াম ও বরিক পাউডার। পরে তা বিক্রি করা হচ্ছে ‘খাঁটি’ দুধ হিসেবে।

বিলকিস জাহান নামের এক ব্যাংকার বলেন, আমার প্রথম সন্তানকে ৯ মাস বয়স থেকেই গাভীর দুধ খাওয়াতাম। ১ লিটার করে দুধ রোজ বাসায় দিয়ে যেতেন এক চাচা (বিক্রেতা)। সন্তান বারবার অসুস্থ হওয়ায় ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, খাবারে সমস্যা, দুধে ভেজাল থাকতে পারে। পরে ওই চাচাকে জিজ্ঞাসা করলে জানান, তিনি প্রতিদিন ৭০ কেজি দুধ বিক্রি করেন। দুই ব্যক্তি তাকে তা বিক্রি করতে দেন। ভালো-খারাপ জানেন না।

বাড্ডার শাহজাহান-কাকলী দম্পতি জানান, দুধের মতো একটি পবিত্র খাবার নিয়ে হতাশ হতে চাই না। দুধসহ সব ভেজাল পণ্য রোধ ও চিরতরে বন্ধ করতে সরকারকে সবচেয়ে কঠোর হতে হবে। লোকদেখানো অভিযানে কাজ হবে না।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ এমরান কাছে দাবি করেন, শুধু রাজধানীতেই আড়াই হাজারের উপরে ফার্ম রয়েছে। এসব ফার্ম থেকে দুধে ভেজাল করা হয় না। ১ থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যেই ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। রাজধানীর বাইরে থেকে আসা দুধের বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বারডেম হাসপাতালের সাবেক প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা আখতারুন নাহার আলো জানান, ভেজাল ও নকল দুধ খেয়ে শিশু থেকে সব বয়সীরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। এর শিকার শিশুদের প্রায়ই আমাদের কাছে নিয়ে আসছেন অভিভাবকরা। আলো আরও বলেন, আবার যেটুকু খাঁটি দুধ মিলছে তাতেও থাকছে নানাকিছু। বেশি দুধ ও অর্থের লোভে গাভীতে নানা হরমোন ইনজেকশন দেয়া হচ্ছে, যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে। ফলে এসব দুধে নানা ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকছে। তিনি বলেন, এছাড়া দুধের সঙ্গে মেশানো স্টার্চ, ইউরিয়া, ডিটারজেন্ট, সিন্থেটিক মিল্ক এবং নানাবিধ কেমিক্যাল, যেমন- সোডিয়াম কার্বোনেট, ফরমালিন ও অ্যামোনিয়াম সালফেট বাচ্চাদের শরীরে ঢুকে নানা জটিল রোগ ডেকে আনছে। এমন ভেজাল দুধ খাওয়ার কারণে নারীদের গর্ভপাতের আশঙ্কাও বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভেজাল বা দূষিত খাবারের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৫ বছরেরও কম বয়সী প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার শিশুর মৃত্যু হচ্ছে।

সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মঞ্জুর মোর্শেদ জানান, বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে এমনটা হতো না। হাইকোর্টের নির্দেশনাও পালন করছে না সংশ্লিষ্টরা। কোর্টের নির্দেশনা মানতেও বিলম্ব করছে। বিলম্বের মধ্যেই দুর্নীতিটা লুকিয়ে আছে। তিনি বলেন, দুধ কিংবা যে কোনো ভেজাল রোধে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই।

এ বিষয়ে বিএসটিআই’র উপপরিচালক মো. নূরুল ইসলাম বলেন, আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক দুধের ৮৬টি নমুনা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন আদালতে দিয়েছি। এগুলোতে কোনো ভেজাল মেলেনি। আদালত এতে সন্তোষ না হয়ে পুনরায় প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেন। আমরা এরই মধ্যে প্রায় ২শ’ নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করছি। তিনি বলেন, আমাদের পরীক্ষা আর অন্য সংস্থার পরীক্ষার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এতে করে দুই ধরনের ফল আসছে। নূরুল ইসলাম বলেন, আগামী ২৩ জুনের মধ্যে আমরা আদালতে প্রতিবেদন দেব। তিনি আরও বলেন, বহু ফার্ম রয়েছে যেগুলো বিএসটিআইর অনুমোদন নেই। মাত্র ১২-১৩টি ফার্ম আমাদের তালিকাভুক্ত।

আরও পড়ুন