লামা-আলীকদমে তামাক চাষ বাড়াতে তৎপর তামাক কোম্পানী

NewsDetails_01

লামা পৌর এলাকার হরিণঝিরি এলাকার ফসলি জমিতে একটি তামাক বীজতলা
বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলায় বিগত মৌসুমের ন্যায় চলতি মৌসুমেও ১২ হাজার ৬০০ একর ফসলি জমিতে পরিবেশের ক্ষতিকারক তামাক চাষের ভয়াল বিস্তারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তামাক কোম্পানী। ইতিমধ্যে কোম্পানীগুলো তাদের রেজিষ্ট্রেশনভূক্ত প্রায় সাড়ে ৪ হাজার চাষিকে প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে বীজ, পলিথিন, কীটনাশক, সার ও ঋণ প্রদান করেছে। এখন ফসলি জমি, স্কুলের মাঠ, মাতামুহুরী নদীর চর ও বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমিতেও তামাক বীজতলা করা হয়েছে। গত দুই তিন বছর ধরে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে তামাক চাষীরা, তবুও থামছেনা এ চাষের ভয়াল বিস্তার। তবে গতবারের তুলনায় এবারে তামাক চাষের পরিমান অনেকাংশে কম হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। বিকল্প না থাকায় বাধ্য হয়ে তামাক চাষ করছেন কৃষকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকার তামাক চাষে নিরূৎসাহিত করার নীতিমালা গ্রহণ করলেও লামার ৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকা এবং আলীকদমের ৪টি ইউনিয়নে কয়েকটি তামাক কোম্পানী তৎপর হয়ে উঠেছে তামাক চাষ বাড়াতে। তাদের লোভনীয় ফাঁদে পড়ে গত ২২ বছর ধরে এতদ্বঞ্চলে আশংকাজনক হারে তামাক চাষের বিস্তার ঘটেছে। বিধায় উপজেলা দুটিতে অন্যান্য কৃষিজাত দ্রব্য ও রবিশস্যের ফলন উৎপাদন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। চলতি মৌসুমে আবুল খায়ের টোবাকো, ঢাকা টোবাকো, নিউএইজ ও বিএটিবি কোম্পানীগুলোর সার্বিক সহযোগিতায় তামাক চাষের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষ করে জমিতে তামাক রোপনের কাজ শুরু করেছে কৃষকরা।
সরজমিন ঘুরে দেখা যায়,লামা বন বিভাগের বমু সংরক্ষিত বনাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকার বাড়ীর আঙ্গিনা ও স্কুলের মাঠ থেকে শুরু করে সর্বত্রই তামাক বীজতলা করা হয়েছে। বীজতলায় উৎপাদিত চারা এখন জমিতে রোপনের কাজ শুরু করেছে কোন কোন চাষি। আবার অনেকে জমি প্রস্তুতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। চাষীরা বলেন, মৌসুমের শুরুতেও বৃষ্টি হওয়ার কারণে তামাক বীজ তলা ও জমি তৈরিতে বিলম্ব হয়েছে। ছোট থেকে বড় সব বয়সের নারী পুরুষই তামাক চাষ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
কৃষি অফিস সূত্র মতে, চলতি মৌসুমে কোম্পানীগুলো লামা উপজেলায় প্রায় ১ হাজার হেক্টর ও আলীকদম উপজেলায় প্রায় ৬শ হেক্টর জমিতে তামাক চাষের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে বেসরকারী হিসেব মতে এর পরিমাণ অনেকগুন বেশি হবে বলে ধারনা করছেন সংশ্লিষ্ট চাষীরা।
কোম্পানীগুলো তাদের সঠিক পরিসংখ্যান দিয়ে রেজিস্ট্রেশনকৃত তামাক চাষীর সংখ্যা ও কত একর জমিতে তামাক চাষ হবে তা বরাবরই কৌশলগতভাবে চেপে যায়। তবে বিশ্বস্থ সূত্র মতে, চলতি মৌসুমে লামা – আলীকদম উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আবুল খায়ের টোবাকো কমপক্ষে ৭০০ চাষীর মধ্যে ২২০০ একর জমি, নাসির টোবাকো প্রায় ৩৫০ জন চাষীর মধ্যে ১০০০ একর, ঢাকা টোবাকো প্রায় ১৫০০ চাষীর মধ্যে ৩৮০০ একর, বিএটিবি প্রায় ১০০০ চাষীর মধ্যে কমপক্ষে ২৫০০ একর এবং নিউজএইজ টোবাকো কোম্পানীর ৫৫০ চাষীর মধ্যে ১৬০০একর জমিতে তামাক চাষ করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। এছাড়াও তামাক কোম্পানীগুলোর রেজিষ্ট্রেশন বহির্ভূত তামাক চাষীর সংখ্যাও কমপক্ষে দেড় হাজার হবে বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা। আর এরাও প্রায় ৫০০ একর জমিতে তামাক চাষ করবেন। এ হিসেবে উপজেলা দুটিতে প্রায় ১২ হাজার ৬০০একর ফসলি জমিতে তামাক চাষের প্রস্তুতি চলছে বলে স্থানীয় তামাক চাষীরা জানিয়েছেন।
কোম্পানীর পক্ষ থেকে এসব চাষিদের আগে ভাগেই অর্থ, সার, বীজ, পলিথিন, কীটনাশকসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও প্রদান করা হয়েছে। রেজিষ্ট্রেশনভূক্ত এসব চাষী মৌসুম শুরুর আগেই চড়া মূল্যে ফসলি জমিগুলো অগ্রিম লাগিয়ত নেয়। ফলে সবজি চাষিরা জমি নিয়ে বিপাকে পড়েন।
সবজি চাষি শাহ জাহান মিয়াসহ আরো অনেকে জানান, তামাক চাষিদের অগ্রিম লাগিয়তের কারণে সবজি চাষের জন্য জমি পাওয়া যায়না। আর পাওয়া গেলেও মূল্য বেশি হওয়ায় অনেক সময় জমি লাগিয়ত নেয়া সম্ভব হয়না।
পরিবেশ বিষেজ্ঞরা জানান, বার বার একই জমিতে তামাক চাষের ফলে যেমন এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মাটির উর্বরতা ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি রবিশস্যের উৎপাদনে নেপথ্যচারী হিসেবে নানা অন্তরায় সৃষ্টি করে যাচ্ছে। তাই জনস্বার্থে তামাক চাষ বন্ধে সাংবাদিক আলাউদ্দিন শাহরিয়ারসহ ৩ জন বাদি হয়ে ২০১০ সালে বান্দরবান চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা করলে আদালত ওই বছর পুরো জেলায় মাত্র ১ হাজার একর জমিতে তামাক চাষের অনুমতি দেয়। পরবর্তী বছর থেকে সম্পূর্ণভাবে তামাক চাষের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু কোম্পানীগুলো আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এখনও তামাক চাষ অব্যাহত রেখেছে। এ বিষয়ে টোবাকো কোম্পানীর কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা কোন ধরণের মন্তব্য করতে রাজি হননি।
লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নূরে আলম বলেন, সরকারী ভাবে তামাক চাষ বন্ধে সু -নির্দিষ্ট কোন আইন না থাকায় এ চাষের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছেনা। তিনি আরো জানান, গত বছরের চেয়ে চলতি মৌসুমে অনেকটা কম জমিতে তামাক চাষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে করে এ মৌসুমে রবি শস্যের আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও জানান তিনি।

আরও পড়ুন