রুমায় দুস্থ মহিলাদের চাল নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের চালবাজি !

NewsDetails_01

রুমায় চাল নিয়ে চালবাজির শিকার দুস্থ মহিলারা
বান্দরবানের রুমায় ৪নং গালেঙ্গ্যা ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের ভিজিডি উপকাভোগী ৩১জন দুস্থ মহিলা ১৩মাসের চাল এখনো পাননি।
ভিজিডি কার্ড ও চাল পেতে উপকারভোগিরা ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে অসংখ্যবার ধরণা দিয়েছেন। তবে এখনো ভিজিডি চাল পেতে অনিশ্চয়তা কাটেনি, বরং হয়রানির শিকার ও অর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন দুস্থ মহিলারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের অধীনে বিগত ২০১৭-২০১৮চক্রে মোট ২৪মাসের জন্য রুমা উপজেলায় গালেঙ্গ্যা ইউনিয়নের ভিজিডি উপকাভোগী হিসেবে ৩০৪জন দুস্থ মহিলাকে চুড়ান্তভাবে তালিকাভূক্তি করা হয়। এসব দুস্থ মহিলারা প্রতিমাসে ৩০কেজি চাল মোট ২৪মাস পেয়ে থাকেন। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি উদ্যোগের মধ্যে “সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি”র আওতায় দুস্থ মহিলাদের বিনামূল্যে ভিজিডি চাল বিতরণ করার কর্মসূচী।
আরো জানা গেছে, গালেঙ্গ্যা ইউনিয়নের ভিজিডি কার্ড নিয়ে চেয়ারম্যান ও মেম্বারের মধ্যে রশি টানাটানিতে বাড়ছে দুস্থ মহিলাদের ভোগান্তি। বিগত ২০১৭-২০১৮চক্রে ২৪মাসের মেয়াদে কোনো কার্ড পাননি দুস্থরা। তার মধ্যে চামরুং ম্রো(৩০), সাং পালে পাড়া। যার কার্ড নং ১৫১ এবং শৈয়ং ম্রো(৩৫), কার্ড নং ১৪৫। তারা দু‘জনে গালেঙ্গ্যা ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের পালে পাড়ার বাসিন্দা।
তাদের অভিযোগ মতে, ভিজিডি উপকারভোগী হিসেবে চুড়ান্ত তালিকাভূক্তি হবার পর ২০১৭সালে ফেব্রুয়ারি প্রথম সপ্তাহে স্থানীয় ইউপি মেম্বার রেংচম ম্রো এর কাছে তাদের ভিজিডি কার্ড কোথায় এবং কবে পাবেন, বিষয়টি জানতে চান -দুস্থ মহিলারা। ওই সময় মেম্বার দুস্থদের জানায়, কার্ডগুলো চেয়ারম্যানের হাতে, একথা জানার পর দুস্থ মহিলারা রুমা সদরে গিয়ে গালেঙ্গ্যা ইউপি চেয়ারম্যান শৈউসাই মারমার কাছে খোঁজ নেন তারা। কিন্তু দুস্থ মহিলাদের কপালে মিলেনি ভিজিডি কার্ড।
আবার ওই সময় দুস্থ মহিলাদের ইউপি চেয়ারম্যান শৈউসাই মার্মা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ভিজিডি কার্ডগুলো মেম্বার রেংচম ম্রো নিয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে যেতে বলা হয়- দুস্থ মহিলাদের। পরে তারা কার্ড খোঁজতে যান স্থানীয় মেম্বারের কাছে। তখন মেম্বার রেংচম ম্রো কার্ডগুলো ভুলে অফিস রেখে যাওয়ার কথা জানানো হয়। এতে দুস্থরা বিব্রতবোধ ও হয়রান শিকার হয়ে ক্ষুব্দ হয়ে ওঠেন। এঅবস্থায় এক সপ্তাহ পর আবার দলবেধে ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে ধরণা দেন দুস্থরা। তখন চেয়ারম্যান নিজেই পালে ও কুরাং বাজারে যাবেন, তখন মিমাংসা করে দেবেন এমন কথা জানিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বলা হয়- দুস্থ মহিলাদের। পরবর্তীতে ইউপি চেয়ারম্যান সেখানে যাননি। তবে এর মধ্যে স্থানীয় ইউপি মেম্বার চেংচম ম্রো তার ওয়ার্ডের দুস্থ মহিলাদের কার্ডগুলো পরে দেয়া হবে, এ কথা জানিয়ে তালিকাভূক্ত দুস্থ মহিলাদের বিভাজন করে প্রতিজনকে দুইশ পঞ্চাশ, তিনশত ও চারশত টাকা করে বিতরণ করা হয়।
দুস্থ মহিলারা আরো জানায়, ২০১৭সালে জানুযারি থেকে নভেম্বর মোট ১১মাস নগদ টাকা বিতরণ করলেও তখনো কার্ডগুলো দেয়া হয়নি। ভিজিডি তালিকা থেকে তাদের নাম কেটে ফেলে দেয়ার ভয়ে মেম্বারের কাছে দুস্থরা তাদের কার্ড ওই সময়ে আর চাননি। তবে নীতিমালায় নগদ টাকা দেয়ার কোনো বিধান নেই।
তারা আরো জানায়, ২০১৭সালে ডিসেম্বর থেকে তাদের আর কোনো টাকা দেননি। ওই সময় মেম্বার তাদের জানিয়ে দেন, সরকার চাল সংকটে পড়েছে, চাল আসেনি। চাল আসলে দেয়া হবে। তাছাড়া বর্ষাকাল, দুস্থরাও আর মাতামাতি করেনি জানালেন চামরুং ম্রো।
শৈয়ং ম্রোসহ আরো অনেকে বলেন, ২০১৭সালে ডিসেম্বর ও ২০১৮সালে পুরো বছর মিলে মোট ১৩মাসে কোনো ভিজিডি চাল দুস্থ মহিলাদের না দেয়ার কথা জানিয়ে গত বছর ডিসেম্বর মাসে খ্রিসমাস (শুভ বড়দিন) আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিকট একটি অভিযোগ দাখিল করেন দুস্থ মহিলারা। ভিজিডি কর্মসূচি দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন মহিলা বিষয়ক কার্যালয়। তাই তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেন-ইউএনও।
মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার অভিযুক্ত চেয়ারম্যান ও মেম্বারের পক্ষ নেয়ার আশঙ্কায় ইউএনও‘র নিকট পুনরায় অভিযোগ দাখিল করেন দুস্থ নারীরা। দ্বিতীয়বার অভিযোগটি করা হয় ২৩জানুয়ারি। এসময় ভিজিডি চাল ও কার্ড চাইতে গিয়ে হয়রানি ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থেও কথাও উল্লেখ করেন তারা।
মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা তাঁর কার্যালয়ে অভিযোগকারিদের তদন্ত করার কথা জানিয়ে দুস্থ নাীদের ডেকে পাঠান ৩১জানুয়ারি। হাজির হন দুস্থরা কিন্তু মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েন অসহায় দুস্থ নারীরা।
এই অভিযোগটি সুবিচার চেয়ে জেলা প্রশাসক ও পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবরে ডাকযোগে পাঠিয়েছেন আবারো গত ১২ ফেব্রুয়ারি। এসব অভিযোগ পত্রের সকল অনুকপি পাহাড়বার্তা’র হাতে এসেছে।
গত বৃহস্পতিবার (১৪ফেব্রুয়ারি) বিকালে পালে পাড়ার বাসিন্দা রেং ওযাই ম্রো ডাকযোগের অভিযোগ পত্র প্রেরণের কথা জানিয়ে বলেন, দুস্থ মহিলারা এক প্রকার দুর্বল হয়েছে পড়েছেন। কারণ এখানে-সেখানে যেতেও তাদের টাকা পয়সাও নেই। তাই বলে ১৩মাসের আমাদের প্রাপ্য ভিজিডি চাল পাওয়া থেকে কি বঞ্চিত হবে, এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি।
এদিকে ডিসেম্বর মাসে শেষ সপ্তাহে অভিযোগ দেয়ার পর স্থানীয় মেম্বার রেংচম ম্রো গত ৩ জানুয়ারি কুরাং বাজারে ভিজিডি উপকার ভোগিদের ডেকে পাঠান এবং তাদের কার্ডগুলো বিতরণ করা হয়। কার্ড দেয়ার সময় ভিজিডি চাল চাওয়ায় কয়েকজনকে মারধর ও মেরে ফেলারও হুমকি দেন বলে অভিযোগ করেন শৈয়ং ম্রো। তিনি জানান,পাড়ার প্রতিবেশিদের পরামর্শ ও অনুরোধে হুমকি ব্যাপারে কোথাও লিখিত অভিযোগ করা হয়নি। তবে মৌখিকভাবে ইউপি চেয়ারম্যানসহ অনেকজনকে জানিয়েছেন বলে জানালেন তিনি।
রুমায় চাল না পাওয়ার অভিযোগ পত্রের একাংশ

পাহাড়বার্তাকে অভিযুক্ত ও সংশ্লিষ্টদের বয়ান :
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ শামসুল আলম বলেন, অভিযোগটি মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মাধ্যমে তদন্ত চলছে। তাছাড়া নিজেও খোঁজ খবর নিচ্ছেন, প্রমাণিত হলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে।
মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সুপন চাকমা বলেছেন, তদন্ত চলছে। আর কতদিন লাগবে এমন প্রশ্নে তিনি এড়িয়ে বলেন, অভিযোগকারি ও অভিযুক্ত মেম্মারের মধ্যে পাড়া পর্যায়ে দন্ড রয়েছে। তবে তিনি বলেছেন এতদিন পর অভিযোগ, এখানে মেম্বারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আছে। তাছাড়া নির্বাচন নিয়েও দন্ডের কথা জানালেও কি ধরণের দন্ড ও ষড়যন্ত্র তা কারোর নাম ধরে স্পষ্ট করেননি তিনি। এসব অভিযোগ দেখভালের দায়িত্ব পালনের ঘাটতি কিনা তা জানতে চাইলে এড়িয়ে যান তিনি।
গালেঙ্গ্যা ইউপি চেয়ারম্যান শৈউ সাই মারমা বলেন,৫নংওয়ার্ডের মেম্বার এর মাধ্যমে ২০১৭সালে চক্রটি শুরুতেই ভিজিডি কার্ডগুলো দেয়া হয়েছিল। তবে ওই সময়ে দুস্থ মহিলারা তার কাছে কার্ড চাইতে আসার ব্যাপারে চেয়ারম্যান শৈউসাই বলেন, মেম্বার তাঁর কাছে কার্ডগুলো দুস্থ মহিলাদের বিতরণ করে ফেলেছেন, একথা জানার পর তিনি সেই কুরাং বাজারে আর যাননি।
তবে বিগত পুরো দুই বছরে কোনো উপকারভোগী দুস্থ মহিলা উপস্থিতি ছাড়া মেম্বার এর মাধ্যমে বিতরণ করা নিয়মে পড়ে কিনা এ প্রশ্নে শৈউ সাই বলেন, দুর্গম এলাকা, সেই বিবেচনা মেম্বারের মাধ্যমে দিয়েছি চালগুলো। দুস্থদের চাল আমি (শৈউ সাই চেয়ারম্যান) একটুও আত্মসাত করিনি, সেটা সবার সামনে শপথ নিয়ে বলতে পারি।
অভিযুক্ত ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার রেংচম ম্রো বলেন, উপকারভোগিরা দুর্গম এলাকায় থাকেন। তাই ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে পরামর্শ করে দুস্থদের চাল না দিয়ে নগদ টাকা বিতরণ করে আসছি- শুরু থেকে। এখন শেষ হয়ে গেছে দুই বছর। তারপর আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ঠিক নয়। ভিজিডি চাল আত্মসাতের কথা অস্বীকার করে বলেন, তার ওয়ার্ডের তাকে ভাল দেখতে পারেননি, এমন গোষ্ঠি আছে। তাদের ষড়যন্ত্র শিকার হয়েছেন বলে জানালেন তিনি।

আরও পড়ুন