পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করছে অপরাজেয়

NewsDetails_01

বান্দরবানের থানচি উপজেলার দূর্গম অথুই প্রু মার্মা পাড়ায় বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করছে অপরাজেয়
পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি জনগোষ্ঠির উন্নয়নে কাজ করছে অপরাজেয়। বান্দরবানের থানচি উপজেলার দূর্গম অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি কাজ শুরু করেছে প্রায় এক বছর আগে। ইতোমধ্যে থানচির কমপক্ষে ২৫টি পাড়ার মানুষ এতে সরাসরি উপকৃত হয়েছে। শিক্ষা, স্যানিটেশন, কর্ম-সংস্থান, বাজার ব্যাবস্থাপনা, স্থানীয়দের দক্ষতা বৃদ্ধিসহ স্থানীয় পন্যের দেশী ও আর্ন্তজাতিক ব্রান্ডিং করছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
২০১৩ সালে ভয়াল রানা প্লাজা দূর্ঘটনার পর আহত শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের জন্য চালু হয় অপরাজেয়। শতভাগ রফতানীমুখী এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ তথা এশিয়ার একমাত্র শ্রমিক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও এটি বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে সফলভাবে পরিচালিত শ্রমিক মালিকানার মডেল। ইতোমধ্যে এই ব্যাবসায়িক মডেলটি নিয়ে সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানির ম্যাক্স প্লান্ক ইনিস্টিটিউট সহ বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণা হয়েছে। অপরাজেয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নিউ উয়র্ক টাইমস, বিবিসি ইউকে, আল জাজিরা, এনএইচকে, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালসহ বহু দেশী-বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। শুরুতে শুধুমাত্র পাটের ব্যাগ তৈরী করলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি তৈরী পোশাক, কৃষিপণ্য এবং বিকল্প জ্বালানী ব্যাবস্থা নিয়ে কাজ করছে।

►পাহাড়ে অপরাজেয়
২০১৬ সালে পাহাড়ের কিছু অঞ্চলে খাদ্যসংকট দেখা দিলে এই অঞ্চলে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে অপরাজেয়। এরপর প্রায় এক বছর ধরে চলে বিভিন্ন পর্যায়ের মাঠ-অনুসন্ধান, প্রশিক্ষণ এবং পরিকল্পনার কাজ। এই অঞ্চলের আদিবাসীদের নিজস্ব দক্ষতা এবং স্থানীয় কাচামাল ব্যাবহার করে পণ্য উৎপাদন ছিলো অপরাজেয় এর লক্ষ। ফলে দির্ঘসময় ধরে চলে স্থানীয় পর্যায়ের মাঠ অনুসন্ধান। এরপর ধীরে ধীরে কাজ শুরু হয় গতবছর এর মাঝামাঝি দিকে।

NewsDetails_03

►বাজার ব্যাবস্থাপনা
দূর্গম অঞ্চল, শিক্ষার অভাব এবং বাজার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠী কখনোই তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না। নিজেরা সরাসরি বাজারজাত করতে না পারার কারনে বিভিন্ন শ্রেনীর মধ্যসত্ত¡ভোগী হাতিয়ে নেয় লাভের সবটুকু। ফলে উৎপাদন পর্যাপ্ত হলেও কৃষক লাভবান হয় না। এই সমস্যা সমাধানে অপরাজেয় থানচি উপজেলার তিন্দু, রেমাক্রি, বলিপাড়া, হালিরাম পাড়াসহ মোট ৮টি পয়েন্টে কৃষিপন্য ক্রয়কেন্দ্র চালু করেছে। এই ক্রয়কেন্দ্রগুলোতে সরাসরি উৎপাদক তার কৃষিপণ্য বিক্রি করেতে পারছে। নিবন্ধিত কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা কৃষিপণ্য অপরাজেয়-এর ব্যবস্থাপনায় চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে। বিক্রয়কৃত পণ্যের লভ্যাংশের একটি অংশ আবার ফেরত যাচ্ছে কৃষকদের কাছে। এই ব্যাবস্থাপনায় চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত স্থানীয় বাজারদরের চাইতে কৃষকদের প্রায় ২১ লক্ষ টাকা বেশি প্রদান করা হয়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে ২৫ টি পাড়ার প্রায় ৫৪০ জন নিবন্ধিত কৃষক রয়েছেন। এই সংখ্যা এবং কাজের ব্যাপ্তি বৃদ্ধির জন্য অপরাজেয় কাজ করে যাচ্ছে।

►ফল ও সব্জি চাষ

পাহাড়ি অঞ্চলে চাষ উপযোগী পেঁপে এবং কলাসহ বিভিন্ন মৌসুমি সব্জি চাষ শুরু করেছে অপরাজেয়। ইতোমধ্যে থানচি উপজেলায় ৩০ হাজার পেঁপে এবং ৫০ হাজার কলা গাছ রোপনের কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়াও আগামী ১ বছরের মধ্যে এক লক্ষ কাজু বাদাম চারা রোপনের কাজ চলছে। এই পুরো পক্রিয়া স্থানীয়দের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাদের পতিত জমিতে যৌথ মলিকানার ভিত্তিতে করা হচ্ছে। ফলে স্থানীয় লোকজন লাভবান হওয়ার পাশাপাশি বিপুল পরিমানের পতিত জমিতে বনায়ন হচ্ছে। এছাড়াও উৎপাদিত পন্য উচ্চ মূল্য এবং সংরক্ষনশীল হওয়ায় তা স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারজাত করা সম্ভব হবে।

►কোমর তাঁত ও হস্ত শিল্প
স্থানীয় জনগোষ্ঠির দক্ষতা এবং তাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য্য সামগ্রীর নকশায় কিছু পরিবর্তন করে তা থেকে উন্নতমানের পণ্য তৈরী করছে অপরাজেয়। ব্রান্ডিং এর মাধ্যমে তৈরী হচ্ছে এই সব পন্যের আন্তর্জাতিক বাজার চাহিদা। স্থানীয়দের কোমর তাঁতে তৈরী থামি থেকে বানানো মেয়েদের স্কার্ট, জ্যাকেট ইতোমধ্যে সুইজারল্যান্ড ও জামার্নিতে পরীক্ষামূলকভাবে রফতানি করা হয়েছে এবং বিপুল সাড়া পাওয়া গেছে। বর্তমানে অপরাজেয়-এর সাথে থানচি উপজেলার বিভিন্ন পাড়ার প্রায় ১৩০ জন নারী এই কোমর তাঁত বোনার কাজ করছে। এছাড়াও স্থানীয়দের প্রাকৃতিক রং তৈরী এবং তা কাপড়ে প্রয়োগের প্রশিক্ষন দেয়া হচ্ছে। খুব শীঘ্রই অপরাজেয় থানচিতে একটি কোমর তাঁতে কম্পোজিট কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করবে। এই কারখানায় ৪০ টি সেমি-অটোমেটিক তাঁত, ৩০টি কোমর তাঁত ছাড়াও সুতা তৈরী এবং কাপড় রং করার জন্য একটি প্রাকৃতিক ডাইং ফ্যাসেলিটি থাকবে। কারখানাটি চলতি বছরের শেষ নাগাদ শুরু করার লক্ষ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই কারখানায় সরাসরি ২৫০ জন শ্রমিক কাজ করতে পারবে। এছাড়া প্রাকৃতিক রং উৎপাদন, প্রক্রিয়া করনে আরো কমপক্ষে ৩০০ লোকের কর্মসংস্থান হবে।

বান্দরবানের থানচি থেকে উৎপাদিত হলুদ ও মরিচ প্রক্রিয়াজাত করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌছে দিচ্ছে অপরাজেয়
তাঁত ও হস্তশিল্প ছাড়াও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হলুদ, পাহাড়ি মরিচ প্রক্রিয়াজাত করে তা মোরকিকরণ এবং স্থানীয় তেতুল, আম, জলপাই, চালতা, বাশ কোরল, সাতকরা থেকে আচার তৈরীর প্রাথমিক ও পরীক্ষামূলক কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে এইসব পন্য পরিক্ষমূলক ভাবে উৎপাদন করে বিভিন্ন দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে পাঠানো হয়েছে যা ক্রেতা ও ভোক্তাদের বিপুল আগ্রহ তৈরী করতে সমর্থ হয়েছে।
উৎপাদন ও বাজার ব্যাবস্থাপনার পাশাপাশি অপরাজেয় স্থানীয়দের শিক্ষা ও স্যানিটেশন নিয়েও কাজ কারছে। ইতোমধ্যে থানচির তিন্দু ইউনিয়নের একটি পাড়ায় দির্ঘদিন বন্ধ ও পরিত্যাক্ত থাকা একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় সচল করা হয়েছে। এছাড়াও একই গ্রামে ৮ টি স্যানিটারি টয়লেট নির্মান এবং পানি সরবরাহের জন্য জিএফএস নির্মান করা হয়েছে। বর্তমানে জিএফএস এর পানি দিয়ে সেচ ব্যাবস্থা চালুর কাজ চলছে গ্রামটিতে। গত ১৮ জুলাই দীর্ঘদিন নষ্ট হয়ে থাকা থানচি সদরের মূল জিএফএস অপরাজেয় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে মেরামত করে। এর ফলে থানচির প্রাায় ২৫০০ লোকের পানির দূর্ভোগ লাঘব হয়।
এভাবে বিভিন্ন উন্নয়নমুখী দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি স্থানীয় অধিবাসীদের বিভিন্ন সমস্যায় স্বপ্রনোদিতভাবে এগিয়ে এসে কাজ করছে অপরাজেয়। এই কাজে স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সংস্থা,শিক্ষক, ব্যবসায়ী তথা সর্বস্তরের অধিবাসীরা আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতা করছে। কারন থানচিতে আশার আলো দেখাচ্ছে অপরাজেয়।

আরও পড়ুন