নির্বিচারে পানির উৎস ধ্বংস, পানি সংকটে বান্দরবান

NewsDetails_01

Bandarban-news-3-picনির্বিচারে পানির উৎস ধ্বংস এবং প্রচন্ড গরমে গ্রীস্মের শুরুতেই তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বান্দরবান শহরসহ আশপাশের পাহাড়ী গ্রামগুলোর জীবনযাত্রা। বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে জেলার দূর্গম আদিবাসী পল্লীগুলোতে বেড়ে চলেছে পানি বাহিত রোগের প্রকোপ।

জেলার দূর্গম থানছি, নাইক্ষ্যংছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা গুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংটক দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় কয়েক ঘন্টা পায়ে হেটে ঝিরি-ঝর্না, ছরা, খাল থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছে স্থানীয় বাসিন্দারা। দিন দিন পানির উৎস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট তীব্র আকার ধারন করছে। যার ফলে বাধ্য হয়ে পুকুর, নদী ও খাল বিলের দূষিত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে এসব এলাকার বাসিন্দাদের।

চিম্বুক এলাকার এ্যাম্পু পাড়ার বাসিন্দা লুরা ম্রো জানান, প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি ঝিরি থেকে প্রতিদিন খাবার পানি সংগ্রহ করেন তিনি। প্রচন্ড গরমে মাথায় থ্রুং বেঁধে উঁচু নিচু রাস্তা পেরিয়ে পায়ে হেটে যেতে হয় প্রায় ১ কিলোমিটার দূরের ঝিরিতে। এলাকায় বিশুদ্ধ পানির কোন উৎস না থাকায় এ কাজ নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়া, টায়ফয়েডসহ নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে পাড়ার শিশুসহ শত শত লোক।

রুমা সড়কের গেৎসমানি পাড়ার বাসিন্দ ক্যথোয়াই ম্রো জানান, পানীয় জল এবং নিত্য ব্যবহারের প্রয়োজনীয় পানির জন্য এ পাড়ার নিকটবর্তী একটি ঝিরির উপর প্রায় হাজার খানেক লোক নির্ভরশীল। কিন্তু প্রতি বছর শুস্ক মৌসুমে কিছু অসাধু ব্যবসায়ি অবৈধ ভাবে এ ঝিরি থেকে লক্ষ লক্ষ ঘন ফুট পাথর উত্তোলন করে পাচার করে থাকে। যার ফলে দিন দিন পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে এবং নষ্ট হচ্ছে পানির উৎস। দূষিত হয়ে পড়ছে ঝিরির পানি। ফলাফল হিসেবে স্থানীয়রা পানিবাহিত রোগসহ নানা দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে।

বান্দরবান সদরের ডলুপাড়া, মুরুক্ষ্যংমুখ পাড়া, চিক্যা কারবারী পাড়া, গলাচিপা পাড়া, ওয়াব্রাইং পাড়া, জামছড়ি পাড়া এবং পাশ্ববর্তী রোয়াংছড়ি উপজেলার দূর্গম ঘেরাওমুখ পাড়া, নোয়াপতং মৌজার আন্তাহা পাড়া, কানাইজো পাড়া, নাছালং পাড়াসহ আশ পাশের এলাকাগুলোতেও চলছে পানির তীব্র সংকট।

রোয়াংছড়ি উপজেলার ঘেরাওমুখ পাড়ার কারবারি (পাড়া প্রধান) অংসাখয় মার্মা জানান, পাড়ার বাসিন্দারা যুগ যুগ ধরে পাশের কয়েকটি ঝিরি থেকে সারা বছর বিশুদ্ধ পানীয় জলসহ ব্যবহারের পানি সংগ্রহ করত। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্মের শুরুতেই ঝিরি-ঝর্নার পানি শুকিয়ে যায়। তাছাড়া পাহাড়ি দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বিশুদ্ধ খাবার পানি সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। পানির চাহিদা মেটাতে এখানকার লোকজনের কষ্টের যেন অন্ত নেই। শিঘ্রই এ পাড়ার ঝিরি-ঝর্নাসহ পানির উৎসগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা না গেলে লোকজনের বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়বে পাড়াগুলো। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

NewsDetails_03

বান্দরবান মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষন কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম জানান, পাহাড়ে অপরিকল্পিত জুম চাষ, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, বন-জঙ্গল উড়াজ ও ঝিরি ঝর্না থেকে অবাধে পাথর উত্তোলনের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে পাহাড়। এতে ঝিরি-র্ঝনা, ছরা, নদী, খাল-বিল এর পাশ্ববর্তী স্থানে গাছপালা কমে গিয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে পানির উৎস। শিঘ্রই এসব বন্ধ করা না গেলে চরম পানি সংকট দেখা দিতে পারে পাহাড়ি এলাকাগুলোতে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের সূত্রমতে, ২০০৩ সালে জেলায় জনসংখ্যা ছিল ২৩ লক্ষ ৭৬ হাজার ৮০ জন ও পানির কভারেজ ছিল ৬৩.২৬%। কিন্তু ২০১৩-১৪ সালে জনসংখ্যা বেড়ে ৪ লক্ষ ৪ হাজার ৯৩ জন হওয়াতে পানির কভারেজ ৫০.৬৭% এ নেমে আসে।

এ বিভাগের আওতাধীন বিশেষ গ্রামীণ পানি সরবরাহ, পিইডিপি-৩ প্রকল্প, বান্দরবান পার্বত্য এলাকার নিরাপদ পানীয় জলের সমস্যা নিরসণ কর্মসূচী, বান্দরবান এবং লামা পৌরসভার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কর্মসূচী, বান্দরবান জেলা ও সকল উপজেলা হেডকোয়ার্টারে পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নকরণ, বন্যা দূর্গত এলাকায় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পূনর্বাসন ও উন্নয়ন ইত্যাদি চলমান প্রকল্পের মাধ্যমে পানি সংকট নিরসনের চেষ্টা চলছে।

এছাড়া বান্দরবান পার্বত্য জেলার প্রত্যন্ত পশ্চাদপদ দূর্গম পাহাড়ি এলাকার জনগোষ্ঠির জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ করণ কর্মসূচীসহ নতুন কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জেলার পানি সংকট বহুলাংশে লাঘব হবে বলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল সূত্র জানায়।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বান্দরবান বিভাগের সহকারি প্রকৌশলী আবদুল বাতেন জানান, জেলার ৭টি উপজেলায় মোট নলকুপের সংখ্যা ৮৬৬৯টি। তার মধ্যে চালু অবস্থায় রয়েছে ৬৯৫৯টি এবং অকেজো অবস্থায় রয়েছে ১৭১০টি। এছাড়া অগভীর নলকুপ রয়েছে ১০৫৫, ডিএসপি নলকুপ রয়েছে ১৫০৩টি, তারা ডিপসেট রয়েছে ১৪১২টি, পাতকুয়া রয়েছে ৩৭১২টি, ইনফিলট্রেশন গ্যালারী রয়েছে ১৪টি, রেইন ওয়াটার রিজার্ভার ৩৯টি, ছড়া উন্নয়ন ৮৬টি এবং পুকুর খনন ও পিএসএফ নির্মাণ করা হয়েছে ৬টি। এগুলোর বেশির ভাগ নলকুপ, পাতকুয়া, তারা ডিপসেট দ্বারা পানির চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। তবে কিছু কিছু নলকুপ, রিংওয়েল, টিউবওয়েল অকেজো অবস্থায় রয়েছে। এগুলোও পর্যায়ক্রমে মেরামত করা হবে এবং পানির চাহিদা পূরণের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বান্দরবান বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সোহরাব হোসেন জানান, জেলার স্বল্পসংখ্যক সমতল এলাকায় অগভীর ও গভীর নলকুপ দ্বারা পানি উত্তোলন সম্ভব হলেও অধিকাংশ এলাকায় ভৌগোলিক কারণে পানি উত্তোলন সম্ভব হচ্ছে না। ভূ-প্রকৃতগত ভাবে পার্বত্য এলাকায় পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। এছাড়া বন জঙ্গল উজাড় ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে পানির উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও শতভাগ বিশুদ্ধ খাবার পানির সংস্থান করা যাচ্ছেনা। পানির উৎস সংস্কার ও রক্ষনাবেক্ষনের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরন সম্ভব হবে।

এছাড়া বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য টিউবওয়েল, রিংওয়েল ও জিএফএস নির্মাণ কার্যক্রম চলছে। প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দারা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে গৃহীত প্রকল্পগুলোর সুবিধাও ভোগ করছেন বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন