লামায় পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে ৫ হাজার পরিবার

NewsDetails_01

লামা পৌর এলাকার চেয়ারম্যান পাড়ায় পাহাড় কেটে স্থাপিত কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ বসতঘর
পাহাড়ি জনপদ বান্দরবানের লামা উপজেলা। এখানকার ছোট-বড় পাহাড়ে জনবসতির ইতিহাস প্রায় চার যুগেরও বেশি। শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ পাহাড়ের চূড়া, পাদদেশ ও কোল ঘেঁষে বসবাস করে আসছে। আর বর্ষা মৌসুম এলেই এ অঞ্চল পরিণত হয় আতঙ্কিত জনপদে। তবে পরপর কয়েক বছরের পাহাড় ধস ট্রাজেডির কারণে এ পার্বত্য জনপদে বসবাসকারি অধিবাসিরা বর্ষা মৌসুমে যেন পাহাড় দেখলে রীতিমত আঁতকে উঠে। অথচ এখনো পাহাড়ে রয়ে গেছে হাজার হাজার পরিবার। একের পর এক পাহাড় ধসে প্রাণহানির মত মানবিক বিপর্যয় ঘটলেও নেয়া হয়নি পরিকল্পিত বসবাস কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারিদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা। ফলে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিলে বেড়েই চলছে লাশের সংখ্যা। শুধু তাই নয়, পাশাপাশি বিধস্ত হচ্ছে ঘরবাড়িও।
গত তিন দিনের হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাতে পৌর এলাকাসহ উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যে পাহাড় ধস শুরু হয়ে গেছে। বর্ষার শুরুতেই ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে উপজেলা প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে মাইকিং করে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হুেচ্ছ কিন্তু এখনো কেউ নিরাপদে সরে যায়নি। পরিবারগুলোর স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেই কোনো সংস্থার। স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করা না হলে পাহাড় ছাড়তে নারাজ ঝুঁকিতে বসবাসকারীরা।
এখনিই পাহাড়ের মৃত্যুঝুঁকিতে বসবাসকারি পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরিয়ে না নেয়া হলে আবারো পাহাড় ধসে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। জরিপে জেলার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে বসবাসকারী লামা উপজেলা হলেও পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে বসবাসরত পরিবারগুলোর কোনো নির্দিষ্ট তালিকা নেই প্রশাসনের কাছে। এছাড়াও দাতা সংস্থাগুলো প্রতি বছরেই হাজার কোটি টাকা কথিত উন্নয়ন কাজের নামে উপজেলায় ব্যয় দেখায়। কিন্তু বর্ষায় উপজেলাবাসীর দুর্যোগকালীন ও বন্যা থেকে মুক্ত থাকার বিষয়ে মানবিক সহায়তা হিসেবে কোনো ধরনেরই আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপনের কর্মসূচিও নেই ওইসব সংস্থার।
২০০১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী জানা যায়, উপজেলার ৬৭১.৮৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৬ হাজার ৬৩টি পরিবার রয়েছে। আগের তুলনায় বর্তমানে এর সংখ্যা দ্বিগুন বাড়বে বলে পরিসংখ্যান অফিস সূত্র জানিয়েছে। সে হিসেবে এ উপজেলায় পাহাড়ী ও বাঙ্গালী মিলে দেড় লাখ মানুষের বাস। এদের মধ্যে ৯০শতাংশ মানুষ ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে ৮শ-১৫শ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া, পাদদেশ কিংবা পাহাড়ের কোলঘেঁষে বসবাস করে আসছে। যার বেশির ভাগই পুণর্বাসিত ও অজ্ঞ। তারা ১৯৭৯-৮০ সালের দিকে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে এসব উপজেলায় পুণর্বাসিত হয়ে পাহাড় কেটে বসবাস শুরু করে ঝুঁকি মাথায় নিয়ে। বেসরকারী হিসাব মতে, লামা পৌরসভা ও লামা সদর, গজালিয়া, রূপসীপাড়া, সরই, আজিজনগর, ফাঁসিয়াখালী, ফাইতং ইউনিয়নে সাড়ে ৪ হাজার পরিবারের প্রায় ২০ হাজার মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে বসবাস করছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, লামা পৌরসভা এলাকার চেয়ারম্যান পাড়া, নারকাটাঝিরি, হাসপাতাল পাড়া, বরিশাল পাড়া, বড়নুনারবিল পাড়া, চাম্পাতলী, নয়াপাড়া, সাবেকবিলছড়ি, রাজবাড়ী, কলিঙ্গাবিল, কাটাপাহাড়, মধুঝিরি ও ছাগল খাইয়া গ্রামে পাহাড় ধস ঝুঁকিতে বসবাস করছে কয়েকশ পরিবার। এসব পরিবারের ঘরগুলোর কিছু পাহাড়ের পাদদেশে, কিছু খাঁজে আবার কিছু চুড়ায়।
এভাবে উপজেলার আজিজনগর, ফাইতং, রুপসীপাড়া, লামা সদর, গজালিয়া ও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকার পাহাড় কেটে অপরিকল্পিতবাবে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করে আসছে পাঁচ হাজারেরও বেশি পরিবার। তাদের বেশিরভাগই হতদরিদ্র মানুষ। তার মধ্যে সাড়ে চার হাজার পরিবারই অতিঝুঁকিতে বসবাস করে আসছে। এসব পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য বর্তমানে উদ্বিগ্ন উপজেলা ও পৌরসভা প্রশাসন।
পাহাড় কেটে বসতঘর তৈরি করে বসবাসকারী জামালজানায়, আমরা গরীব মানুষ, এখানে সমতলের জমির দাম আকাশ ছোঁয়া। এত দরে আমাদের পক্ষে জমি কেনা অসম্ভব। পাহাড়ের জমি সমতল ভূমির চেয়ে অনেক সস্তা। তাই পাহাড়ের জমি কিনে বসবাস করছি।
লামা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের পাহাড়ে অতিঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারী এসব পরিবারে যে কোন সময় বড় ধরণের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তারা শুধু মৃতুঝুঁকিতে বসবাস করছে তা নয়, জীবন যাত্রায় পানি, আবহাওয়া, সামাজিক পরিবেশ, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ সুবিধাসহ নাগরিক অনেক সুবিধা এরা ভোগ করতে পারছে না।
উপজেলার রুপসীপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ছাচিং প্রু মার্মা, ফাইতং ইউপি চেয়ারম্যান মো. জালাল উদ্দিন জানিয়েছেন, নানা কারণে দারিদ্রতার রোষানলে পড়ে এখানকার মানুষগুলো সমতলে জমি কিনতে পারছেনা বিধায় ঝুঁকিপূর্ণ ঘর ছেড়ে নিরাপদে আশ্রয় নেওয়া তাদের পক্ষে কোন ক্রমেই সম্ভব হচ্ছে না। তবে ঝুঁকিপুর্ণ পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে গিয়ে আশ্রয় গ্রহনের জন্য দফায় দফায় তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় জনপ্রতিধিরা জানিয়েছেন, গত তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে পাহাড় ধসের ঘটনার পর পরই প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা পাহাড়ের ঝুঁকিপুর্ণ বসতঘরগুলো সরানোর উদ্যোগ গ্রহণের পর সরকার পরিবর্তন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সমন্বয়ের অভাবে তা আর বেশিদূর এগোয়নি। প্রকৃতির ন্যায় প্রতিবছরই বর্ষা এলেই স্বল্প সময়ের জন্য প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষ পাহাড়ের পাদদেশে ঘরগুলো নিয়ে তারা ঢাকঢোল পিটিয়ে পাহাড়ে ঝুঁকিপুর্ণদের নিরাপদে বসবাসের তাগিদ দিয়ে অফিসের রুটিন শেষ করেন। অথচ পাহাড় ধস ঘটনার পর তৎসময়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে পুর্ণবাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। সময়ের সাথে সাথে তাদের কার্যক্রমে ভাটা পড়ে যায় বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
এদিকে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিংয়ের মাধ্যমে বার বার তাগিদ দেয়া হচ্ছে বলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার খিনওয়ান নু জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, লামা উপজেলায় ব্যাপক আকারে পাহাড় ধস শুরু হয়েছে ১৯৯৯ সাল থেকে। ওই বছর আগস্টে আজিজ নগরে চিউরতলী এলাকায় এক রাতে শতাধিক পাহাড় ধসে পড়ে। সেখানে তিনজন নিহত ও ১২ জন আহত হন। তবে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে ২০০৯ সাল থেকে। ওই বছর আজিজনগরে তিন পরিবারের ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর ২০১২ সালে লামা ফাইতং ইউনিয়নে এক পরিবারের ১১জনসহ ২৯ জন নিহত হন। এ ছাড়া ২০১১ ও ২০১৩ সালে দুজন করে ও ২০১৪ সালে তিনজনের মৃত্যু হয়। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাতে বসতঘরে পাহাড় ধসে পড়ে লামা সদর ইউনিয়নের বরিশাল পাড়ায় ৬ জনের মৃত্যু হয়। তবু সরে যায়নি ওইসব এলাকায় বসবাসকারী ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলো।
বান্দরবানের মৃত্তিকা সংরক্ষণ ও পানি বিভাজিকা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম বলেন, পাহাড়ি পরিবেশে লাগসই বসতি গড়ে না তোলা, নির্বিচারে বন বৃক্ষ কেটে ভূমিতে চাষাবাদ করে মাটি ক্ষয় করা, পাহাড় কাটা, অধিকসংখ্যক বন কেটে জ্বালানি ব্যবহার, পানির উৎস থেকে প্রাকৃতিক পাথর সরিয়ে ফেলার কারণে পাহাড় ধস হচ্ছে। এসব নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে পাহাড় ধসের মাত্রা আরও বাড়তে পারে।
এ বিষযে লামা উপজেলা চেয়ারম্যান থোয়াইনু অং চৌধুরী বলেন, এখানে বসবাসকারি অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে। তাদের সবার পক্ষে নিজ উদ্যোগে নিরাপদে সরে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারিদের পূর্নবাসন সহায়তা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন