বান্দরবানের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সেকাল-একাল

NewsDetails_01

বান্দরবান সদরে এখন যা বঙ্গবন্ধু মুক্ত মঞ্চ (গরাদ ঘেরা) আগে এর নাম ছিল মুজিব পার্ক। জাতীয় দিবসসহ প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সেখানেই হতো। অনুষ্ঠান হবে সন্ধ্যা ৭টায় আর আমরা তথা দস্যুর দল উপস্থিত বিকাল ৪টায়। আমাদের আসন সবার আগে, অর্থাৎ মঞ্চের একেবারে পাশে,ত্রিপল বিছানো মাটিতে। সেখানেই কার জায়গা কোথায় হবে তা নিয়ে অনেক ঝগড়া বিতন্ডা। অপেক্ষার প্রহর কাটেনা,কখন পালি স্যার (দীপ্ত বড়ুয়া) হুইসেল বাজাবেন,পর্দা উঠবে। টান টান উত্তেজনা। বাপ্পি দত্তের একটি নৃত্যের কথা এখনো ভুলিনি,সে পিঠে ময়ূরের পেখম গুঁজে চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে কত্থক নাচ করতো।
তখন সাংস্কৃতির ত্রাণ কর্তাদের মধ্যে ছিলেন জনিবাবু,দিলীপ চক্রবর্তী,প্রয়াত রশিদ মাস্টার,প্রয়াত সামসুল হক,সুধাংশু বিমল চক্রবর্তী,স্বপন দত্ত,সাধন (পদবী মনে নেই) প্রমূখ। আহা নাচ,গান, কৌতুক, নাটক আরো কতো মনরাঙানো পরিবেশনা। সেই সময় ছিলো যেন সোনালী সময়।
এক সময় বেশি বয়সে হওয়ার পর জেলা শিল্প কলা একাডেমীতে ২য় ব্যাচে কন্ঠ সংগীতে ভর্তি হলাম। ওস্তাদ ওহিদুল আলম স্যার,বাবু অরুণ সারকী,বাবু আশুতোষ সরকার,বাবু পরিতোষ কুমার দাশ এবং এর বাহিরে সম-সাময়িক শিশু একাডেমি’র বাবু শান্তিময় চক্রবর্তী,শিল্পী বাবু থোয়াই চিং প্রু নীলুসহ আরো গুণী জনের সান্নিধ্য পেয়েছি। আমার নাটক বিষয়ে গুরু ছিলেন দিলীপ চক্রবর্তী।
অরুণদা’র সাইকেল ছিল,সেটি আর আমি একাকার। অনুষ্ঠান হবে,তাই কোন কাজের গ্যাপ থাকলে অবিরাম সাইকেল রেস্। অনুষ্ঠানের আগে প্রতিটি আইটেমের সপ্তাহ ব্যাপী নিখুঁত মহড়া,মহড়া ছাড়া কোন পরিবেশনা মঞ্চস্থ হবেনা। তাই প্রতিটি পরিবেশনা মন্ত্রমুগ্ধের মত গ্রহন করতেন দর্শক স্রোতা। এই কাজটি আমাদের সময় কঠোর হাতে পরিচালনা করতেন প্রয়াত অরুণদা। গান করলে যে টাকা পাওয়া যায় সেটি আমাদের ধারণার বাইরে ছিল।তবে তখন শিল্পীদের আপ্যায়ন আদর যত্নের কমতি ছিলনা।
সেই সময়ে বান্দবানের অনেক সোনার সন্তান সাংস্কৃতি বিষয়ে জাতীয়পর্যায়ে এলাকার মুখ উজ্জ্বল করেছে। তাদের কথা এখন সবার স্মৃতির অতলে।
বর্তমানে গান বাজনা পেশা এবং সেখানেই গন্ডগোল “বুকটা ফাইট্যা যায়” মার্কাগানে,–“পিছনে তালি কই?”.. “সবাই”…. “তালিহবে”। আরে বাবা,ভাল লাগলে তালি কেন! দর্শক টাকাও দেয়। যতো গান নয় ততোধিক ডিজিটাল যন্ত্রের গর্জন!নর্তন কুদ্দন তো আছেই। তখন আমরা মাইকে গান করেছি,মাইকে গান করে দর্শকের স্ব-প্রণোদিত হাততালি যে শিল্পী কুঁড়াতে পারতেননা সেই শিল্পীর ঠাঁই মঞ্চে হতোনা।
শিল্পকলা একাডেমি তখন জেলা প্রশাসনের আওতায় ছিল পৃষ্টপোষকতাও ছিল। ছিল আন্তরিকতাও। বর্তমানে জেলা শিল্পকলা একাডেমির জমি আছে,ভবন নেই। লাল ফিতায় সব কিছু স্থবির। কোনদিন হবে কিনা সন্দেহ আছে। মূলত বান্দরবানে বাঙালী সাংস্কৃতির সূতিকাগার এখন ….। সেই অবকাশে বিকৃত সংস্কৃতির প্রসার রমরমা। খুব কম সংখ্যায় ভাল গানের আসর হয়,তবে তা ভিআইপি,ভিভিআইপিদের জন্য। সেখানে সাধারণ দর্শকের যাওয়ার প্রশ্নই আসেনা।
আকাশ সংস্কৃতির কারনে আমরা একেতো কোনঠাসা, অন্যদিকে ভাল পরিবেশনার অভাবে দর্শকও দিনদিন রুচি হারাচ্ছে। তার উপর যোগ হয়েছে সিন্দাবাদের ভূত-অশিল্পী সংগঠক। স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় অনুষ্ঠান হলে পকেট ভারী করার সুযোগটি অপেক্ষাকৃত কম। অন্যদিকে বাহিরের শিল্পী আনলে বিমান বাড়া,গাড়ীভাড়া,থাকা খাওয়া,শিল্পী সন্মানী যন্ত্রী সন্মানী,প্যান্ডেল খরচ ইত্যাদি বাবদ চোখ ছানাবড়া করা অংকের টাকার বিল প্রদর্শন করে সেখান থেকে একফসলা রমরমা বাণিজ্য করার সুযোগতো রয়েছেই। অথচ এই বিপুল অংকের টাকার সামান্য অংশ খরচ করে স্থানীয় ভাল শিল্পীদের অভিজ্ঞ বাদ্যযন্ত্রীদের সহযোগে অনুষ্ঠান করলে দর্শকের রুচি পরিবর্তন হতে বাধ্য।
বান্দরবানে জাতীয় দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অবস্থা আরো হতাশা জনক। ব্যাঙের ছাতার মত সংগঠন, সারা বছর অনেকের কোন কার্যক্রম নেই। বিশেষ দিবসে ধারকরা জোড়া তালি দেওয়া পরিবেশনা নিয়ে উপস্থিত। এদের নিয়ে আয়োজকও বিব্রত।
আরো কিছু বিশেষ অনুষ্ঠান হয় গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর মত। কিছু শিল্পী(?) নিজ খরচে হারমোনিয়াম তবলা মাথায় করে নিয়ে গিয়ে অভুক্ত পেটে “বাপের দিন্যা” সুরে গান গেয়ে আসে। দায়বদ্ধতার কারণে সেসব অনুষ্ঠানে আপদকালীন সময়ে কোন সচেতন শিল্পী দূর্ভাগ্য বসত বাধ্যতামূলক আমন্ত্রণ (আদেশ) পেয়ে বড়ই অপমানিত বোধ করতে দেখেছি।
তবুও সংশ্লিষ্ট সকলের সুমতি হোক,বিবেক জাগ্রত হোক। বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন এলাকায় পাহাড়ি সাংস্কৃিতর সমান তালে বাঙালীর শেকড়ের সাংস্কৃতি টিকে থাকুক, এটাই হবে প্রত্যাশা।

NewsDetails_03

লেখক: জাহাঙ্গীর আলম। সাংস্কৃতিক কর্মী,বান্দরবান।

প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। পাহাড়বার্তার -এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য পাহাড়বার্তা কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না

আরও পড়ুন