বন্য হাতির নিত্য আক্রমনে নাইক্ষ্যংছড়ির ২০ গ্রামের মানুষ চরম আতঙ্কে

NewsDetails_01

বান্দরবানের মায়ানমার সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় অন্তত ২০ গ্রামের মানুষ বন্যহাতি আতংকে দিনযাপন করছে। প্রতি রাতে বন্য হাতির পাল লোকালয়ে নেমে বিভিন্ন ক্ষেত খামার ও বসতবাড়িতে দফায় দাফায় হামলা চালানোর ফলে পাহাড়ি এসব গ্রামে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে হাজারো মানুষ।
সূত্র মতে, জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী পাহাড়ে বন্য হাতির উপযোগী খাদ্যের অভাবের কারণে প্রতিদিন বন্য হাতির পাল দল বেঁধে লোকালয়ে নেমে আসে এবং মানুষের বাড়িতে রক্ষিত ধান, ক্ষেত খামার সাবাড় ছাড়াও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করছে। অনেকে হাতির ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছে।
জানা গেছে, নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের গয়ালমারাঝিরি, আমতলীমাঠ, ফজুরছড়া, লম্বামাট, চেরারমাঠ, হামিদিয়াপাড়া, ফুলতলী, প্রধানঝিরি, দোছড়ি ইউনিয়নের বাহিরমাঠ, কামিরমুখ, চিকনছড়ি, ছাগলখাইয়া, ডলুঝিরি, গুরুন্নাকাটা ও সোনাইছড়ি ইউনিয়নের মারোগ্যপাড়া, লামারপাড়া, বৈদ্যপাড়া, বটতলীপাড়া, ঘুমধুম, তুমব্রু এলাকায় প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই বন্য হাতির পাল লোকালয়ে নেমে আসে। বন্য হাতি খাদ্যের সন্ধানে মানুষের বসতবাড়ি ও আঙ্গিনা গুড়িয়ে দেয়। এসব বন্য হাতির পাল থেকে রক্ষা পেতে পালাতে গিয়ে অনেকে হামলার শিকার হয়েও মৃত্যুবরণ করেছে।
এ ব্যাপারে সোনাইছড়ি ইউনিয়নের মংছহ্লা মার্মা জানান, বন্য হাতির পাল বিভিন্ন বাগানে আশ্রয় নিয়ে থাকে। ফলে বাগান মালিকপক্ষ ব্যাপক ক্ষতির শিকার হচ্ছে, পাশাপাশি লোকালয়ে নেমে হামলা চালায় প্রাণহানি ঘটছে।
এছাড়াও সদর ইউনিয়নের জামছড়ি এলাকার বাসিন্দা ঠান্ডা মিয়া, সোনাইছড়ি ইউনিয়নের নন্নাকাটা গ্রামের সুগত বড়ুয়া, বজেন্দ্র বড়ুয়া, মো: আলম, মো: শাহজালালের বসতবাড়িও একইভাবে হাতির পাল ধ্বংস করে দেয়। এ ব্যাপারে, জামছড়ি এলাকার জয়নাল জানান, শুধু সাহায্য নয়, খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসা বন্য হাতির কবল থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে বাঁচতে চান তিনি।
সোনাইছড়ি ইউপি সদস্য নুর নাহার বেগম এ প্রতিবেদকে জানান, সম্প্রতি উপজেলায় সব চেয়ে বেশি বন্য হাতির পাল তান্ডব চালাচ্ছে তাঁর এলাকায়। যার কারনে মানুষ অধিকাংশ সময় নির্ঘুমে রাত অতিবাহিত করে। আক্রমণ থেকে এলাকার লোকজন রক্ষা পাওয়ার জন্য স্থায়ী পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনসহ সরকারের প্রতি দাবি জানান তারা।
গবেষকরা বলছেন, হাতির বিচরণ ভূমিতে মানুষের হানা, প্রকৃতিতে খাদ্য সংকট সহ নানা কারণে বাড়ছে মানুষ-হাতির এমন দ্বন্ধ। এ কারণে বাংলাদেশ থেকে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির এ বন্ধু। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়ন (আইইউসিএন) বাংলাদেশের এ হাতিকে ‘গভীর সংকটাপন্ন’ প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বন্য হাতির হামলার বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি বন রেঞ্জ কর্মকর্তার দাবী, বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় ও নির্দিষ্ট অভায়ারণ্য না থাকার কারণে বন্য হাতি লোকালয়ে হামলা চালাচ্ছে। হাতির বিচরণ ক্ষেত্র ছেড়ে দিলে লোকালয়ে হাতির আক্রমণ কমে যাবে। এছাড়াও লোকালয়ে বন্য হাতির বিচরণের কারণে বাইশারী ইউনিয়নের সাঙ্গু মৌজায় সম্প্রতি পাঁচ হাজার ৭৬০ একর পাহাড়ি অঞ্চলে হাতি সংরক্ষণের জন্য অভায়শ্রম তৈরির কাজ চলছে বলে তিনি জানান।
সূত্র মতে, বন্য হাতির আক্রমণে নিহত পরিবারকে বন বিভাগের মাধ্যমে সরকার এক লাখ টাকা এবং আহত ব্যাক্তিদের ধরন অনুযায়ী ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে নূন্যতম ২৫ হাজার টাকা হারে সাহায্য দেয়া হয়। হাতির আক্রমণে নিহত পরিবারকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তা দেয়া হয় বলে জানান নাইক্ষ্যংছড়ি প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা দপ্তরের অফিস সহায়ক সোহেল।
উল্লেখ্য, গত দুই বছরে অন্তত ২০জন প্রাণ হারিয়েছে নাইক্ষ্যংছড়িতে। যার মধ্যে ২৩ ডিসেম্বর ২০১০ সনে বাইশারীতে সাজেদা বেগম (৪২), কহিনুর আক্তার (১০), রোজিনা আক্তার (৬), ২৬ আগস্ট ২০১৩ চিকনছড়ি এলাকায় আহামদ নবী (৪২), ১৮ অক্টোবর ২০১৩ গুরুন্নাকাটার মোহাম্মদ হোছন (৫৫), ৯ নভেম্বর ২০১৩ ছাগলখাইয়া এলাকায় মো আফজল প্রকাশ কালাম বকসু, ২০১৩ সনের মার্চে দোছড়ির বদিউল আলম, ২১ ডিসেম্বর ২০১৩ ফুলতলী এলাকায় মো: শফি আলম (১৪), ১৮ জানুয়ারি ২০১৪ প্রধানঝিরি এলাকায় নুরুল ইসলাম (৬০), ২১ জানুয়ারী ২০১৪ দোছড়িতে এজাহার মিয়া (২৮) ৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৪ দোছড়ি ইউনিয়নে এনাম উদ্দিন (৫২), ২৮ এপ্রিল ২০১৪ ঘুমধুমে শফিকুর রহমান (৩২), ১১অক্টোবর ২০১৪ আশারতলী এলাকায় আবদু সালাম (২৫), ২৫ মে ২০১৪ ঘুমধুম উলুবনিয়ায় গৃহবধু সাজেদা খাতুন, ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ সোনাইছড়ি ইউনিয়নে মোজাফফর আহামদসহ প্রায় অর্ধ শতাধিক সাধারণ কৃষক, গৃহবধূ, শিশুসহ কাঠুরিয়াকে পায়ে পিষ্ট ও শুঁড়ের হামলায় মারা যান। এছাড়াও এসব ঘটনায় আরো দুই শতাধিক আহত ও কয়েক শত বসতবাড়ি এবং ক্ষেত খামার গুড়িয়ে দেয় বন্য হাতির পাল।
এ ব্যাপারে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম সরওয়ার কামাল জানান, বন্য হাতি লোকালয়ে খাদ্য না পেয়ে সাধারণ মানুষের উপর হামলা চালাচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

আরও পড়ুন