মুদি দোকানি রত্নার ঘরে চার ‘রত্ন’

NewsDetails_01

চার ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত করে মানুষের মতো মানুষ করার এক মহান যুদ্ধে নেমেছেন রত্না সেন। কাপ্তাইয়ের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ওয়াগ্গা ইউনিয়নের সাফছড়িতে বসবাস তাঁর। স্বামী মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। বাধ্য হয়ে সংসারের হাল ধরেন রত্না। এলাকায় খুলে বসেন মুদির দোকান। খেয়ে না খেয়ে কাটছে দিন। তবু ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করেননি। রত্নার স্বপ্ন, অন্ধকার একদিন কাটবেই। আঁধার ঘরে চাঁদের আলো আসবেই …

হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে বিনা চিকিৎসায় না ফেরার দেশে চলে যান স্বামী। অন্ধকার নেমে আসে রত্না সেনের (৪৫) দুই চোখে। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে মাথা গোঁজার জায়গাটুকুও নেই।

অনাহারে-অর্ধাহারে কাটে দিন। স্বাক্ষরজ্ঞান থাকলেও কোনো স্কুলে যাননি রত্না। কিন্তু জীবনযুদ্ধে হার মানতে রাজি নন তিনি। ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার শপথ নেন।
কাপ্তাইয়ের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ওয়াগ্গা ইউনিয়নের সাফছড়িতে এখন রত্নার বসবাস। সাফছড়ি গ্রামে বাঙালি বলতে হাতেগোনা কয়েকজন। তঞ্চঙ্গ্যা ও মারমা অধ্যুষিত ওই গ্রামে ঘাগড়া-বড়ইছড়ি রাস্তার পাশে তিনি গড়ে তোলেন একটি মুদির দোকান।

রাউজানের দেওয়ানপুর গ্রামের নিতাই সেনের ছেলে দয়াল সেনের সাথে ১৯৯১ সালে পারিবারিকভাবে ঘর বাঁধেন রাঙ্গুনিয়ার বেতাগী ইউনিয়নের পালপাড়ার মোহন বাঁশি সেনের মেয়ে রত্না সেন। কিছুদিন পর রাঙামাটির ঘাগড়া বাজারে স্বামীর ব্যবসাসূত্রে ভাড়া বাসায় ওঠেন তাঁরা। তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে অভাবের সংসার হলেও সন্তানদের পড়ালেখায় আগ্রহী স্বামী-স্ত্রী দুজনেই। স্বপ্ন দেখতেন ছেলেমেয়েরা উচ্চ শিক্ষিত হয়ে পরিবারের অভাব দূর করবেন। প্রয়োজনে না খেয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ জোগান তাঁরা। রত্নার সব আশা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় ২০১২ সালে স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে। তখন মেয়ে পূজা সেন (১৯), জয়া সেন (১৭), প্রিয়া সেন (১৫) ও ছেলে জয় সেনের (১৩) পড়ালেখাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ঘাগড়া বাজারে স্বামীর রেখে যাওয়া তিন শতক জায়গা ছাড়া মাথা গোঁজার জায়গাটুকুও ছিল না। হাতে কোনো পুঁজিও ছিল না। তখন জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে রত্না সাফছড়িতে একটি মুদির দোকান খুলে বসেন। স্বামীর বন্ধুত্বের সম্পর্কে ঘাগড়া বাজারের পাইকারি এক দোকানদারের কাছ থেকে বাকীতে অল্প মালামাল এনে সাফছড়িতে বিক্রি করে সপ্তাহ শেষে পরিশোধ করে বেঁচে থাকার যুদ্ধে নামেন রত্না। একাজে তাঁকে সহায়তা করে বর্তমানে ওয়াগ্গা স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছেলে জয় সেন। স্কুল শেষে দোকানের হিসাব-নিকাশ রাখা ও ঘাগড়া বাজার থেকে মালামাল আনার কাজটুকু করে ছেলে। মা-ছেলে দুজনের থাকা খাওয়াসহ বসবাসের জায়গাটুকুও দোকানটির এক কোণে। তিন মেয়েকে পাঠিয়ে দেন রাঙ্গুনিয়ার বেতাগীতে বাবা মোহন বাঁশীর কাছে। বাবার বাড়িতে রেখে তিন মেয়েকে পড়ালেখা করাচ্ছেন রত্না। বড় মেয়ে পূজা সেন চুয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে নার্সিং ডিপ্লোমা করছেন কক্সবাজার নার্সিং ইনস্টিটিউট থেকে। মেজ মেয়ে জয়া সেন এবারে এ গ্রেডে এইচএসসি পাস করেছেন ইমাম গাজ্জালি ডিগ্রি কলেজ থেকে। সেও এসএসসিতে পড়ত চুয়েট স্কুলে। খরচ চালাতে না পারায় পাশের ইমাম গাজ্জালি কলেজে যান এইচএসসিতে। এখন চেষ্টা করছেন সরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য। ছোট মেয়ে প্রিয়া সেন চুয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে গতবার এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে একাদশে ভর্তি হয়েছে একই প্রতিষ্ঠানে। কাপ্তাইয়ের ওয়াগ্গা স্কুলের সপ্তম শ্রেণির মেধাবী ছাত্র ছেলে জয় সেন থাকে মায়ের সাথে দোকানে।

তিন মেয়েকে পড়ালেখার পাশাপাশি নাচ, গান, আবৃত্তিসহ সংস্কৃতিচর্চার পাঠটিও রপ্ত করান রত্না। সন্তানদের কষ্টের মধ্যে রেখে পড়ালেখা করানোর পাশাপাশি তিনি দীক্ষিত করেছেন সততা ও নৈতিকতার শিক্ষায়। রত্না সেন স্বপ্ন দেখেন, তাঁর চার সন্তান শত অভাবের মধ্যেও পড়ালেখা বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাবে অনেক দূর। সন্তানদের হাত ধরেই তার ‘আঁধার ঘরে চাঁদের আলো’ আসবেই একদিন।

NewsDetails_03

চোখে ছলছল পানি নিয়ে রত্না সেন জানান, ঘাগড়া বাজারে স্বামী দয়াল সেনের বড়সড় মুদির দোকান ছিল। মোটামুটি সুখেই চলছিল তাঁদের সংসার। ঘাগড়া বাজারে আগুন লেগে একবার সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায় দয়াল সেনের। সেই ক্ষত কাটিয়ে ওঠার আগেই স্বামী চলে যান না ফেরার দেশে। ‘এর পর আমার সংগ্রাম শুরু। চার ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করা যেমন দুরূহ ছিল, তেমনি তাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়াও ছিল অসাধ্য। মাঝে মাঝে আত্মীয়-স্বজনরা কিছু সহযোগিতা করলেও তা ছিল অপ্রতুল। এই একটি মাত্র দোকান থেকে নিজের এবং ছেলেমেয়েদের খাওয়া ও পড়ালেখার খরচ জোগাতে হয়। ’-বলেন রত্না সেন।

ভোর হতে রাত অবধি এই মুদি দোকানে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে নিজের দুটি হাতকে কর্মের হাতে পরিণত করেছেন জানিয়ে রত্না সেন বলেন, ‘এক মুহূর্তের জন্যও মনোবল হারাইনি। কারণ ছেলেমেয়েদের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই, সুখ খুঁজে পেতে চাই তাদের মাঝে। ’

চার সন্তান মানবিক গুণাবলি অর্জন করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং নিজেদের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়ে নিজের সংসার আলোকিত করবেন সর্বদা সৃষ্টিকর্তার কাছে সেই প্রার্থনাই করেন রত্না।

বড় মেয়ে পূজা সেন বলেন, ‘মা হচ্ছেন আমাদের আদর্শ। মা কখনো বাবার অভাব বুঝতে দেননি। চার ভাইবোনের পড়ালেখার খরচ জোগাতে মায়ের পরিশ্রম সার্থক হবে তখনই, যখন আমরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে মায়ের জীবনের আঁধার দূর করে তাঁর স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারব। ’

ওয়াগ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুবিমল তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে রত্না সেন এই এলাকায় সততার সাথে মুদি দোকানের ব্যবসা করে আসছেন। তাঁর চার সন্তানকে উপযুক্তভাবে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সাফছড়ি পল্লীর অনেকে এই নারীর কর্মদক্ষতার প্রশংসা করেন। ’

সাফছড়ি উপজাতীয় পল্লীর কার্বারি পূর্ণচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘পুরো গ্রামের মানুষের কাছে রত্না সেন অনুকরণীয়। তাঁর কর্মস্পৃহা আমাদেরকেও অনুপ্রাণিত করে। উপযুক্ত সহযোগিতা পেলে তাঁর ছেলেমেয়েরা আরো এগিয়ে যাবে। তাঁর সন্তানরাই একদিন সব দুঃখ ঘুচিয়ে ঘর আলোকিত করবেই। সূত্র : কালেরকণ্ঠ

আরও পড়ুন