অন্তরের পশু হত্যা করা না হলে প্রাণী কোরবানি দ্বারা কোনো লাভ হয় না

NewsDetails_01

images ঈদ মোবারক। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে যুগান্তরের সব পাঠককে জানাই ঈদের আন্তরিক শুভেচ্ছা। ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের এই মহান দিনে ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে’ মানুষ তার মনের পশুটিকে জবাই করুক; ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত এই দিনটির সব মালিন্য ঘুচে যাক, তার অমলিন দীপ্তি সবার মনে সত্যাগ্রহ জাগ্রত করুক, এই প্রার্থনা করি কায়মনোবাক্যে।

শৈশবে রোজার ঈদের মতো কোরবানির ঈদও ছিল আমাদের কাছে অতি আনন্দের। কখন ভোর হবে, ভোরের আজান শুনব, তারপর বেলা বাড়বে, ঈদগাহে ঈদের নামাজের জন্য ছুটব, তারপর গরু কোরবানি দেখব, এই প্রত্যাশায় রাতে চোখে ঘুম আসত না। এখন বয়স হয়েছে। গরু কোরবানি ধর্মীয় অত্যাবশ্যক কর্তব্য জেনেও একসঙ্গে এত গরু, ছাগল ও ভেড়া নিধনের ক্লেশ মনে অনুভব করি। তবু জানি, এটা আল্লাহর বিধান। তার নির্দেশ। এই নির্দেশের কাছে মাথানত করা ছাড়া একজন বান্দার আর কীই বা করার আছে!

আল্লাহ হজরত ইব্রাহিমকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি দিতে হবে। হজরত ইব্রাহিমের কাছে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু বা ব্যক্তি ছিলেন তার কনিষ্ঠ পুত্র হজরত ইসমাইল। পিতা তার প্রিয়তম পুত্রকেই কোরবানি দিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ইসমাইল অলৌকিক উপায়ে বেঁচে যান। এই প্রিয়তম বস্তু আল্লার নামে উৎসর্গ করতে গেলেও বুকে কী দারুণ ব্যথা বাজে, তার অভিজ্ঞতা আমার কৈশোর জীবনেই লাভ করেছি। সেই কাহিনীও এখানে বলি।

আমার এক মামার দুটি দুধেলা গাভী ছিল। তাদের একটি সন্তান প্রসবের পরে দেখা গেল, সেটি ষাঁড় নয়, গরু। মায়ের পেট থেকে বের হয়েই সে মাঠময় দৌড়াতে শুরু করে। তার গায়ের রঙ সাদা-কালো মেশানো। মায়াভরা আয়ত চোখ। কেমন করে জানি না, জন্ম থেকেই তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আমরা তার নাম রেখেছিলাম মঙ্গলা। কয়েক মাসের মধ্যে মঙ্গলার সঙ্গে আমার এমন সখ্য গড়ে উঠেছিল যে, আমি বিকালে স্কুল থেকে ফিরে মামাবাড়িতে গিয়ে মঙ্গলা বলে ডাকলেই আমার কাছে ছুটে আসত। আমার হাত থেকে ঘাস খেত।

বাংলা ১৩৫০ সালের কথা বলছি। আজ থেকে ৭৩ বছর আগের কথা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখন বাংলার মাথার ওপরেও ঘনিয়ে এসেছে। বর্তমান মিয়ানমার (বার্মা) দখলের পর জাপানিরা কলকাতা ও চট্টগ্রামেও বোমাবর্ষণ করেছে। ব্রিটিশ সরকারের অভিশপ্ত খাদ্যনীতির দরুন অবিভক্ত বাংলাদেশজুড়ে চলেছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষে ৫০ লাখ নর-নারীর মৃত্যু হয়। এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের বছরেও বাঙালি মুসলমানের দ্বারে এলো ঈদুল আজহা। আমাদের বা আমাদের মামার পরিবারের হাতেও তখন টাকার টানাটানি। গরু কিনে কোরবানি দেয়ার মতো সঙ্গতি নেই। তবু পরিবারের জেদ কোরবানি দিতেই হবে।

অনেক ভাবনা চিন্তার পর ঠিক হল, মঙ্গলাকেই এবার কোরবানি দিলে কেমন হয়। আমি তো শুনেই চিৎকার করে কেঁদে উঠেছি, না, তা হয় না। মঙ্গলাকে কিছুতেই জবাই করতে দেব না। মামা শক্ত মনের মানুষ। তিনি যুক্তি দেখালেন, আল্লাহ মানুষকে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি তার নামে উৎসর্গ করতে বলেছেন। মঙ্গলা আমাদের সবার অতি আদরের প্রাণী। তাকে কোরবানি দিলে আল্লাহর আদেশ পালন করা হবে। আবার কোরবানির গরু কেনার বিরাট খরচও বেঁচে যাবে।

সেবার আমার কান্না, আপত্তি, প্রতিবাদ কিছুই কাজে লাগেনি। মঙ্গলাকে ঈদের নামাজের শেষেই কোরবানি দেয়া হয়। আমি প্রতি বছর আর সব ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিলে কোরবানি দেখতাম। সে বছর ধারে-কাছেও ছিলাম না। বাড়ির কোরবানির গোশত পর্যন্ত খাইনি। শুনেছি, মঙ্গলাকে জবাই করার সময় মাটিতে শোয়ানোর পর সে সবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল। আমি বহু বছর তার সেই ফ্যালফ্যাল চাহনির কথা ভেবেছি; আর কোরবানির গরু জবাই দেখতে যাইনি।

ধর্মের বিধান। তাই পশু হত্যার বিরোধিতা করি না। কিন্তু পশুক্লেশ ও অনাবশ্যক পশু হত্যায়- বিশেষ করে গরু হত্যায় আপত্তি জানাই। শুধু ধর্মীয় বিধানের জন্য নয়, গরুর মাংস পুষ্টিকর খাদ্য, এই কারণেও গরু জবাই বন্ধ করার আন্দোলন চালালেও তা বন্ধ করা যাবে মনে হয় না। ব্রিটেনে কয়েক বছর আগে ‘ম্যাড কাউ ডিজিজ’ দেখা দেয়ায় প্রায় সবাই গরুর মাংস খাওয়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। ব্রিটেনের গরু সেই রোগমুক্ত হতেই দ্বিগুণ উৎসাহে গরু হত্যা চলছে।

NewsDetails_03

তবে ইউরোপের দেশগুলোতে প্রাণী হত্যারও একটা সুষ্ঠু নিয়ম আছে। অসুস্থ গরু-ভেড়া হত্যা করা চলবে না এবং প্রয়োজনে জবাই করার সময়েও যথাসম্ভব তার ক্লেশ কমাতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পশু জবাই করা চলবে না। এজন্য ইউরোপে পশুক্লেশ নিবারণের শক্তিশালী সংগঠন আছে। তাদের আন্দোলন আছে। বাংলাদেশে- তথা গোটা উপমহাদেশেই পশুক্লেশ নিবারণের কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। আমি ঢাকায় থাকার সময় দেখেছি, অসুস্থ ও রোগগ্রস্ত গরু, ছাগলই আগে জবাই করে বাজারে তার মাংস বিক্রি করা হতো। হালে সরকারি ব্যবস্থায় কড়াকড়িতে এই অবস্থাটা সম্ভবত একটু বদলেছে। তবে জবাই করার সময় পশুক্লেশ নিবারণের কোনো আধুনিক ব্যবস্থা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ইসলামেও কোরবানির পশুকে যথাসম্ভব কম কষ্ট দিয়ে জবাই করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ নির্দেশের দিকে অনেকেই দৃষ্টি দেন না।

কোনো দেশে গো-সম্পদের গুরুত্ব যারা বোঝেন, তারা প্রয়োজনের বাইরে গো-সম্পদ ধ্বংস করার বিরোধী। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গরু-ছাগল তেমন নেই। সেসব দেশে উট-দুম্বা ইত্যাদি কোরবানি দেয়া হয়। উপমহাদেশেই গরু কোরবানি দেয়া হয় বেশি। তাতে প্রয়োজনীয় গো-সম্পদ রক্ষা করা যাবে না, দুধের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে, চাষাবাদে গরু পাওয়া যাবে না ইত্যাদি সমস্যার কথা ভেবে প্রতি বছর ঈদে কোরবানির গরুর সংখ্যা বেঁধে দেয়ার দাবি ব্রিটিশ আমলেই উঠেছিল। কিন্তু তখন তা সম্ভব হয়নি।

উপমহাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় গরুকে গোমাতা ভাবে এবং গরু হত্যা মহাপাপ বিবেচনা করে। ফলে অবিভক্ত ভারতে গরু কোরবানি নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বহু দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে। বর্তমানেও ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এই দলের হিন্দুত্ববাদী উপদলগুলো গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করার জন্য হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন শুরু করেছে। একটি মুসলমান পরিবারকে গোমাংস খাওয়ার অভিযোগে নির্যাতন করেছে। পরিবারের কর্তাকে হত্যা করেছে। তা নিয়ে সারা ভারতে হইচই চলছে।

অবিভক্ত ভারতে রক্ষণশীল হিন্দুরা গোরক্ষা সমিতি গড়ে তোলে এবং গরু জবাই বন্ধ করার আন্দোলন করার ফলে তৎকালীন ভারতে মুসলমানরা গরু জবাই করার ব্যাপারে কোনো প্রকার নীতিমালা মানতে রাজি হয়নি। এটা তাদের ধর্মীয় বিধান ও অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ বলে তারা মনে করেছে। এই ইস্যু নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী বহু দাঙ্গা-হাঙ্গামাও হয়েছে। তৎকালীন অবিভক্ত ভারতে গোরক্ষা ও গোহত্যা একটা সাম্প্রদায়িক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের শাসকরাই বুঝতে পারেন, গো-সম্পদ রক্ষা করা একটি সাম্প্রদায়িক ইস্যু নয়। দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই এটা প্রয়োজন। ফলে পঞ্চাশের দশকের গোড়াতেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার আইন করে দেয় যে, সপ্তাহে একদিন অর্থাৎ কোনো শুক্রবারে গরু হত্যা করা চলবে না। এই আইন বহু বছর বলবৎ ছিল। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর কোরবানির ঈদে কোরবানি দেয়ার গরুর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। নির্বাচনের সময় মুসলিম ভোট লাভের জন্য পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও বাম সব সরকারই বছর বছর কোরবানির গরুর সংখ্যা বাড়িয়েছে। বর্তমানে তৃণমূল সরকারও মুসলিম ভোটের জন্য এই ‘গরুর রাজনীতি’ ত্যাগ করেনি।

আমি যে কথাটা বলতে চই, ধর্মীয় বিধান মেনে বাংলাদেশেও গরু কোরবানি দেয়ার ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে। কিন্তু দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই গো-সম্পদ রক্ষার ব্যবস্থা হওয়া দরকার। গরু কোরবানি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা বন্ধ করা দরকার। বাংলাদেশে এটা এখন লক্ষ্য করার ব্যাপার, ঈদুল আজহায় নব্যধনীরা ত্যাগোৎসবে নয়, ভোগোৎসবে মেতে ওঠে। নিজেদের ধন-ঐশ্বর্যের গরিমা দেখানোর জন্য দুধেল এবং চাষের গরুও জবাই করে। ঈদের গো-হাটে কোনো কোনো গরুর দাম ওঠে লাখ লাখ টাকা। গরুর ঘাটতি পড়লে ভারত থেকে গরু আমদানি এবং চোরা আমদানিও করা হয়। নব্যধনীরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত গরু জবাই করে নিজেদের দাপট ও ঐশ্বর্যের প্রমাণ দেখায়। এই কোরবানির মাংস ধর্মীয় বিধান মেনে গরিবের মধ্যে বিরতণ হয় খুব কমই। তা নব্যধনীদের ভোগের উৎসবেরই উপকরণ হয়। ধর্মের নামে ধর্মীয় বিধানের এই অবমাননা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।

ঈদুল আজহা অবশ্যই আমরা পালন করব। প্রয়োজনমতো গরু-ছাগলও আমরা কোরবানি দেব। কিন্তু প্রতি বছরই আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে অকারণে যেন পশু হত্যা না হয়। গো-সম্পদ ধ্বংস না হয়। প্রয়োজনের বাইরে যেন একটি গরুও হত্যা না করা হয়। দেশে দুধ সরবরাহে সংকট, চাষবাসে গরুর অভাব যেন দেখা না দেয়। কোরবানির নামে বিদেশ থেকে গরুর চোরা আমদানির ব্যবসা বাড়তে না থাকে। গরুচোর নাম দিয়ে সীমান্তে অসহায় মানুষ হত্যা যেন চলতে না পারে।

কোরবানির ঈদ সম্পর্কে নজরুল লিখেছিলেন, ‘ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ, শক্তির উদ্বোধন’- ঈদুল আজহা আমাদের মধ্যে আবার সত্যাগ্রহ জাগাক। হিংসা নয়, শক্তির উদ্বোধন করুক। গরু কোরবানি হোক ত্যাগোৎসবের প্রতীক, ভোগোৎসবের নয়। এই ঈদের মর্মবাণী হল নিজের অন্তরের ভোগ-লালসা, স্বার্থপরতার পশুটি হত্যা করা। ভোগোৎসবের জন্য পশু হত্যা নয়। কেবল পশু হত্যা প্রকৃত কোরবানি নয়। সূত্র : যুগান্তর

আরও পড়ুন