‘ক্যা-নে চলর অ ভ্যাই’ ও বদলে যাওয়া এক জনপদের গল্প

NewsDetails_01

chittagong-0120130709111411 ইউএস বাংলা এয়ারওয়েজের অভ্যন্তরীন একটি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছি। পাশের সহযাত্রী চট্টগ্রামের স্থানীয় এক সংসদ সদস্য। সাক্ষাতের পর তিনি জানতে চাইলেন, “ক্যা-নে চলর অ ভ্যাই?” (কীভাবে চলছে ভাই?)

খুব স্বাভাবিকভাবেই এর উত্তর দিলাম। বিমানবন্দরে নামার পর লাগেজ বেল্টে অল্পপরিচিত এক কর্মচারী জিজ্ঞেস করল, “ক্যা-নে চলর অ ভ্যাই?”

মেজাজটা হঠাৎ তিরিক্ষী হয়ে উঠল। বিমানবন্দর থেকে বাসায় ফিরছি। জিইসির মোড়ে খেয়াল করলাম বাসের এক হেলপার এক রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করছে, “ক্যা-নে চলর অ ভ্যাই?”

এবার বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলাম। পরিচিত কয়েকজনকে ফোন করলাম এ সম্পর্কে জানার জন্য। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এই একটি লাইন চট্টগ্রামের মানুষের মুখে মুখে। চট্টগ্রামের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষত সৌদি আরবে চট্টগ্রামের লোক-অধ্যুষিত অঞ্চলে এটা মোটামুটি ভাইরালে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমতো ঝড় তুলেছে সংলাপটি।

সহকর্মী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগোযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রাজীব নন্দীর লেখায় জানতে পারলাম, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বিবিরহাটে এই সংলাপের সূচনা। মূলত ১:৫৬ মিনিটের এক কল-রেকর্ড থেকে এর সূত্রপাত। এছাড়াও ডব্লিউডব্লিউএফএর জনপ্রিয় বক্সার জন সিনা ও রুসেফের ১:০৩ মিনিটের ডাবিংকৃত এক ভিডিও ইউটিউবে ভাইরাল হয়ে সংলাপটির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। খুলশী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন, বহদ্দারহাট থেকে বন্দর, গার্মেন্টসকর্মী থেকে শুরু করে অভিজাত চট্টগ্রাম ক্লাব, সর্বত্রই এক গুঞ্জন, ‘ক্যা-নে চলর অ ভ্যাই’। বিষয়টা একদিকে যেমন সাধারণের মাঝে নির্মল আনন্দের, অন্যদিকে এটা নিয়ে হয়েছে ব্যাপক ঝগড়া-মারামারি; কখনও-বা ইভটিজিংএর মতো ঘটনাও ঘটেছে। বিষয়টি শিরোনাম হয়েছে পত্রিকার পাতায়। চট্টগ্রামের শীর্ষ দৈনিক আজাদী, পূর্বদেশ প্রথম পাতায় নিউজ করেছে এই সংলাপ নিয়ে।

হঠাৎ করেই এই হালকা চটুল কথাটি সর্বসাধারণের মুখে মুখে কেন, খুব স্বভাবতই এমন প্রশ্ন জাগে। এ ধরনের চটুল স্থূল কথার ঝোঁক আঞ্চলিক ভাষার সহজাত প্রবণতা। যা এর আগে অনেকবার দেখা গিয়েছে। তবে এবারের মতো এত বেশি ভাইরাল আর কখনও হয়নি। সম্ভবত সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমের কারণে এটা হয়েছে।

চট্টগ্রাম ছিল একসময় বিপ্লবীদের জনপদ, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জনপদ। বন্দরনগরী হিসেবে নানা দেশের নানাভাষী মানুষের পদচারণায় মুখরিত জীবন পূর্ণতা পেত নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। নাচ, গান, কবিতা, পাঠচক্রে প্রাণচাঞ্চল্য পেত চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গন।

বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকের সূচনা এই শহরে। এই জনপদের ছেলে নকীব খান, আইয়ুব বাচ্চু, পার্থ বড়ুয়া, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, নাসিম আলী খানের সুরের মুর্ছনায় আমাদের প্রজন্মের বেড়ে ওঠা। ছিলেন শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের মতো আঞ্চলিক গানের শিল্পী। চট্টগ্রামের নিজস্ব কবিয়াল গান ছিল সংস্কৃতির অনন্য ভাণ্ডার। কবিয়াল রমেশ শীল পরিণত হয়েছিলেন কিংবদন্তীতে। মনসুরুল করিম, সৈয়দ ইকবালের মতো গুণী চিত্রকরের জন্ম এই চট্টগ্রামে। বিপ্লবী কল্পনা দত্তের মতো বলতে ইচ্ছে হয়, ‘সে চট্টগ্রাম আর চট্টগ্রাম নাই, বদলে গেছে অনেকখানি’।

আমার বেড়ে-ওঠার শহর, আমার প্রাণের শহর চট্টগ্রামের সঙ্গে আজকের চট্টগ্রামকে মেলাতে পারি না। কোথায় যেন একটি সাংস্কৃতিক শূণ্যতা। একদিন যে চট্টগ্রাম অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির চারণভূমি ছিল, সেই জনপদ হয়ে উঠছে ক্রমশ সাম্প্রদায়িকতার কেন্দ্র। তবু সুখের বিষয়, প্রায় নিভৃতেই বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। চেষ্টা করছে গৌরবের সংস্কৃতি এগিয়ে নিয়ে যেতে। দৃষ্টি, প্রমা, ফুলকি, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের কর্মকাণ্ড চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এরপরও কেন যেন একটা শূণ্যতা।

NewsDetails_03

অনেকে চট্টগ্রামকে ওয়াজ মাহফিলের শহর বলে থাকেন। এর পাশাপাশি শতবর্ষ ধরে এখানে আরও নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সচল ছিল। গ্রামে গ্রামে যাত্রা হত, নাটক হত। বসত বৈশাখী মেলাসহ নানাবিধ গ্রামীণ মেলা। সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও ঐতিহ্যবাহী এসব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এই জনপদের সাংস্কৃতিক জীবনে মোটামুটি খরা বিরাজ করছে। এখানেও বর্তমানে সংস্কৃতির বাহন হয়ে গেছে স্টার জলসা, স্টার মুভিজ। দেশীয় সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে।

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এই জনপদ। দেশের সার্বিক জিডিপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক অগ্রগতি। পোশাক শিল্প ও প্রবাসী আয়ে দেশের যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে চট্টগ্রামের অবদান অনেক বেশি। ফলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এখানে লোকজনের মাথাপিছু আয়, জীবনযাপনের মানে রয়েছে বৈচিত্র্য।

একটা দীর্ঘ সময় ধরে বৈচিত্র্য ছিল এই জনপদের সাংস্কৃতিক জীবনেও। এই বৈচিত্র্যের হাত ধরেই সাতকানিয়ার অজঁপাড়াগায়ের সাধারণ এক কিশোর বুলবুল মাত্র তেইশ বছর বয়সে নৃত্য দিয়ে বিশ্ব জয় করেছিল। আজকের বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা) যার স্মৃতি বহন করে। ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদে প্রথম কবিতা লিখেছিলেন চট্টগ্রামের এক কবি। স্কুলের তেইশ বছর বয়সী এক মাস্টার মশাই বিপ্লবী হয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারের ভিত। একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাক্কালে সাধারণ শ্রমিকরা বিদ্রোহ করেছিলেন সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানোর প্রতিবাদে।

দ্রোহ আর সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে উজ্জ্বল চট্টগ্রাম। মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, স্বদেশ রায়রা একদিন প্রাণ দিয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের প্রতিটি বাঁকে রয়েছে এই জনপদের ভূমিকা। মানিক চৌধুরী, আতাউর রহমান খান কায়সার, জহুরুল হক, এম এ হান্নান, আবদুল্লাহ আল-হারুনের মতো ত্যাগী রাজনীতিবিদদের পদচারণায় মুখরিত হত এখানকার রাজনৈতিক ময়দান। সব কিছুর মতো এখানেও পচন ধরেছে। রাজনীতি থেকে দূরে সরে যেতে হচ্ছে আদর্শিক নেতৃত্বের। সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে নব্য ধনিক শ্রেণি, ব্যবসায়ী ও সুবিধাবাদীরা। স্থানীয় ছাত্ররাজনীতি পথ হারিয়েছে অনেক আগেই।

চট্টগ্রামের মেজবানি, বিয়ে, যৌথ পরিবার কিংবা খাবারের সংস্কৃতি অন্য অঞ্চল থেকে একে আলাদা করবে সবসময়। এগুলো আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তার পরিচায়ক। এ নগরী সবসময় জড়িয়ে ছিল বাঙালি জাতির উত্থানের ইতিহাসের সঙ্গেও। ইতিহাসের সেই সব স্মৃতি কতটা ধরে রেখেছে এই জনপদ? সেখানে আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামে সড়ক রয়েছে। কিন্তু মাস্টারদা সূর্যসেনের নামে কি আছে? নেই! অথচ ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে বলতে দ্বিধা নেই, চট্টগ্রামের ইতিহাস মানেই সূর্যসেন।

যাত্রা মোহন সেন সংক্ষেপে চট্টলবাসীর কাছে জে এম সেন নামে পরিচিত, তাঁর কথা তরুণ প্রজন্মের কে জানে বলুন? অথচ জে এম সেন চট্টগ্রামে নারীশিক্ষার বিস্তারের জন্য শ্বশুরের নামে ডা. খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয় এবং পুত্রবধুর নামে কুসুমকুমারী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চট্টগ্রামে ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চেষ্টা করেছিলেন সমাজ সংস্কারের। প্রীতিলতার বীরত্বের গল্প, কিংবা কল্পনা দত্তের দুঃসাহসিক অভিযাত্রা যদি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করা না যায় তাহলে তাদের মধ্যে ইতিহাস সচেতনতা সৃষ্টির সুযোগ থাকে কোথায়?

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা এই জনপদের গর্ব। এই কথ্য ভাষাতেই রচিত হয়েছে গান, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, কবিগানসহ নানা কিছু। তিনটি পার্বত্য জেলাসহ পাঁচ জেলার প্রায় দুই কোটি মানুষের মুখের ভাষা এটি। কথ্য ভাষার নানা কিছু জনপ্রিয় হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ‘ক্যানে চলর অ ভ্যাই’ সংলাপটি আপাতদৃষ্টিতে খুব স্বাভাবিক একটি বিষয় হলেও, চটুল এই মজাদার সংলাপের জনপ্রিয়তা সমাজের মৌলিক দুটি ত্রুটি আমাদের সামনে তুলে ধরছে। এক, বর্তমান এই জনপদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকার বিষয়টি তুলে ধরেছে। অর্থাৎ একটি প্রতিকূল সময়ে সাধারণ জনগণের আক্ষেপের প্রতিধ্বনি এটি। আবার অন্যদিকে মৌলিকতা-শূণ্য চট্টগ্রামের নিরস সাংস্কৃতিক চর্চার দৈন্যও এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে।

তবু আমরা এক সুন্দর জনপদের স্বপ্ন দেখি। আমার হারানো গৌরবের চট্টগ্রাম ফিরে পেতে চাই। গর্ব করতে চাই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা আর নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে। চাই আমাদের জনপদে আবার সুদিন ফিরে আসুক। সাম্প্রদায়িকতার রাহু গ্রাস থেকে মুক্ত হোক চট্টলবাসীর জীবন। এ জনপদের ওপর সরকারের শুভদৃষ্টি থাকুক সবসময়। উন্নয়নে থাকুক বিশেষ দৃষ্টি। সাংস্কৃতিক জীবনে ফিরে আসুক পূর্বের গৌরব।

তাহলেই প্রকৃত অর্থে ভালো চলবে আমার প্রাণের শহর চট্টগ্রাম। লেখক : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সূত্র : বিডিনিউজ

আরও পড়ুন