শুভ্র ও কেউ একজন

NewsDetails_01

eeসেদিন সন্ধ্যায় বৃষ্টির পর ভেজা রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছিল শুভ্র। চুপ করে বাসা থেকে বের হয়েছিল যেন মা টের না পান। শুভ্রর বয়স ১০ বছর। ছোট্ট একজন মানুষ। তার একা বেড়ানোটা ঠিক নয়। তা ছাড়া ভয় লাগার কথা। কোনো কারণে হয়তো শুভ্রর ভয় লাগে না। এ সময় রাস্তাটা ফাঁকা থাকে, ল্যাম্প পোস্টের আলোয় ভেজা রাস্তার কালো পিচ চিকচিক করে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে হলো, সে একা নয়। কেউ যেন তার সঙ্গে হাঁটছে। সামনে-পেছনে তাকাল। ডানে-বাঁয়ে তাকাল। কেউ নেই। থাকার কথাও নয়। ওপরের দিকে তাকিয়ে শুভ্র অবাক হলো। আকাশ এত সুন্দর গাঢ় নীল হতে পারে, তার ধারণাও ছিল না। আর সে তো ছোট মানুষ, ধারণা করতে যাবে কেন।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই শুভ্রর সমস্যা শুরু হলো। মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল, শরীরটা কেমন হালকা হয়ে গেল। মনে হলো, কেউ যেন তাকে ওপরে টেনে তুলছে। শুভ্র যেন একটা ফাঁপা বেলুন। আবার কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখল উল্টো ব্যাপার—ডান পা-টা তোলাই যাচ্ছে না। কেউ বুঝি মস্ত বড় একটা পাথর বেঁধে রেখেছে।
এরপর শুভ্র দুদিন থেকে বাসায় বন্দী। তার সমস্যা আরও বেড়েছে। কে যেন কানের কাছে গুনগুন করে গান করে। মনে হয়, এই সুর পৃথিবীর নয়, কোনো অপরিচিত জায়গার।
আজ বিকেলে আবার মাকে ফাঁকি দিয়ে শুভ্র পালিয়ে এসেছে বাসার পাশের খোলা মাঠটায়। প্রচুর ঘাস সেখানে। দেখলেই বসতে ইচ্ছে করে। শুভ্র অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, ঘাসেরা তার সঙ্গে কথা বলছে।
‘শুভ্র বাবু, কী অবস্থা?’
কথা বলুক ভালো কথা। ঘাসেরা নাম জানল কীভাবে? শুভ্র কথা বলতে চাচ্ছে না। তারপরও কেন জানি বলে ফেলল, ‘ভালো, তোমরা?’
‘আর বোলো না। গরু তো গরুই। আমরাও তো জীব। আমাদেরও তো মান সম্মান আছে নাকি?’
‘তা তো আছেই।’
‘গরু সেটা বোঝে না। কচকচ করে আমাদের মাথা ছেঁড়ে। ছিঁড়ুক, এটা ওদের অধিকার। কিন্তু গায়ের মধ্যে পায়খানা-প্রস্রাব করে দেয়, এটা সহ্য হয় না। খুবই অসম্মানজনক। হাত থাকলে কানের মধ্যে কশে একটা চড় বসিয়ে দিতাম। বেয়দপ গরু কোথাকার। আদবকায়দা শেখেনি।’
‘উত্তেজিত হয়ো না ঘাস ভাই, একটু থামো।’
ঘাসেরা থামল। শুভ্রর খুব মজা লাগছে গল্প করতে।
শুভ্রর চেহারাটা খুব সুন্দর। দেখলেই কথা বলতে ইচ্ছা করে। কেউ যখন তাকে দেখে বলত, ‘বাবু তোমার নাম কী?’ শুভ্র উত্তর দিতে পারত না, ‘আমার নাম শুভ্র’। সে জন্ম থেকে কথা বলতে পারে না। অথচ আজ ঘাসের সঙ্গে কথা বলছে। কেউ যেন তাকে কথা বলতে সাহায্য করছে!
শুভ্র বলল, ‘আচ্ছা ঘাস ভাই, তোমাদের আনন্দের কথা শোনাবে?’
‘অবশ্যই। আমরা ঘুমাই না তাই দাঁত ব্রাশেরও প্রয়োজন নেই।’
‘দাঁত থাকলে তো ব্রাশ করবে!’
‘ও, আমাদের তো দাঁতই নেই। আমরা সারা রাত জেগে থাকি। আকাশের তারা গুনি। চাঁদ দেখি। বৃষ্টিতে গা ধুই। বাতাসে মাথা দোলাই…।’
মাঠের সবাই অবাক হয়ে একটা বোবা ছেলেকে দেখছে। ঘাসের ওপর শুয়ে আছে। মুখ দিয়ে কী সব শব্দ করছে আর হাসছে। আকাশে মেঘ ছিল। বেশ জোরেশোরেই বৃষ্টি এল। শুভ্র ঘাসের সঙ্গে গল্প করতে করতে বৃষ্টিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল। তার আনন্দ দেখে কে!
বৃষ্টিতে ভিজে শুভ্র খুবই অসুস্থ হয়েছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তাররা রোগ ধরতে পারছেন না। শরীরের তাপমাত্রা ওঠা-নামা করছে। কপালটা কখনো বরফের মতো ঠান্ডা, কখনো আবার এত গরম যে হাত দিতে ভয় লাগে।
শুভ্র বুঝতে পারছে কেউ যেন তার শরীরের ভেতর ঢুকে অঙ্গপ্রতঙ্গগুলো নাড়াচড়া করছে। দেখছে কোনটা কেমন। কোনটা ভালো, কোনটা নষ্ট। নষ্ট অঙ্গগুলো সে বোধ হয় ভালো করে দিচ্ছে। তাহলে তো শুভ্র কথা বলতে পারবে। কী মজা! কিন্তু এখন কাউকে সে মজার ব্যাপারটা জানাতে পারছে না।
শুভ্রর মা খুব কাঁদছেন। শুভ্র বলতে পারছে না, ‘কেঁদো না মা। আমি একটু পরই ভালো হব। তোমাকে আজ “মা” বলে ডাকব।’
নবম শ্রেণি, রংপুর জিলা স্কুল । সূত্র : প্রথম আলো

আরও পড়ুন