হঠাৎ চাপে অস্বস্তিতে বিএনপি

NewsDetails_01

দল পুনর্গঠনের পথে থাকা বিএনপি যখন বিভিন্ন সমীকরণ মেলাতে ব‌্যস্ত, তখন রাজনীতির ময়দানে আকস্মিক কিছু ঘটনাপ্রবাহে অপ্রত‌্যাশিত অস্বস্তিকর পরিস্থিতির চাপে পড়েছে দলটি।
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি সেই চাপকে আরো বড় করে তুলেছে। তিন মামলায় দলীয় প্রধানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি, হঠাৎ করে দলীয় নেতাকর্মীদের ‘ব‌্যাপক হারে ধরপাকড়’, জোটের প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের গ্রেপ্তার, প্রধান বিচারপতির ছুটির প্রসঙ্গ নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে দলটি।
গত ১৫ জুলাই চিকিৎসার জন্য লন্ডন গিয়ে এখনো ফেরেননি বেগম খালেদা জিয়া। তার অনুপস্থিতিতেই বৃহস্পতিবার দুর্নীতি ও জাতীয় পতাকার মানহানির দুটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। এর মধ্যে বেগম জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানিতে হাজির না থাকায় বৃহস্পতিবার তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান।
আর স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে দেশের মানচিত্র এবং জাতীয় পতাকার মানহানি করার অভিযোগে আরেক মামলায় সমন জারির পরও আদালতে না আসায় বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ঢাকা মহানগর হাকিম নূর নবী। এর আগে সোমবার বিস্ফোরক আইনের একটি মামলায় খালেদা জিয়াসহ ‘পলাতক’ আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
গত চারদিনের ব‌্যবধানে তিনটি পৃথক মামলায় বিএনপি প্রধানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিকে সরকারের ‘প্রতিহিংসা আর ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছে বিএনপি। বিশেষ করে খালেদা জিয়া যখন চিকিৎসার জন‌্য বিদেশে অবস্থান করছেন, তখন এই মুহূর্তে তার অনুপস্থিতিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন দলটির দায়িত্বশীলরা।
যেমনটি বলছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী,‘তার দেশে ফেরার মুহূর্তে জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি সরকারের কুটচাল বাস্তবায়নের অংশ। প্রধান বিচারপতির নাজেহালের দৃশ্য দেখে গোটা বিচার বিভাগ এখন শঙ্কিত হয়ে পড়ছে, এজন্য তাঁরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। এই সুযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তা সরকারের সর্বোচ্চ স্থান থেকেই হুকুম হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন,‘কারসাজির নির্বাচনসহ একের পর এক সরকারের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মসূচি সফল করতে বিএনপি চেয়ারপারসনকে নিয়ে সরকারের নানামুখী সুক্ষ্ম কুটকৌশলপূর্ণ কর্মকাণ্ড দেশবাসীর বুঝতে বাকী নেই। সরকার বিরোধীদলগুলোকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।’
গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে আইনিভাবে মোকাবেলা করার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও মোকাবেলা করার কর্মসূচি নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে বিএনপি দেশব‌্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে। নতুন করে দিয়েছে প্রতিবাদ কর্মসূচিও। তবে কর্মসূচি পালনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের ‘ব‌্যাপকহারে গ্রেপ্তারে’র ঘটনা অবাক করেছে দলটিকে। নেতারা বলছেন, আন্দোলন নেই, পরিস্থিতিও স্বাভাবিক; এই পরিস্থিতিতে সরকারের এই ধরনের আচরণ কেন?
বিষয়টিকে ‘সাংবিধানিক অধিকার হরণ’ অভিহিত করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার হরণ করে দেশে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখতে চায় এই সরকার। সেজন্যই বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বড় কিংবা ছোট সভা সমাবেশ বা মিছিলকেও বরদাশত করতে পারছে না। আর এজন্যই পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করার এবং তাদেরকে গ্রেপ্তার করে কারান্তরীণ রাখার জন্য।’ বিএনপি নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ‌্য করার ছক নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এজন‌্য বিভিন্ন মামলায় তাকে সাজা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টি দেশের রাজনীতির জন‌্য ভালো নয় বলে মনে করেন তারা।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রাজনীতির জন‌্য ইতিবাচক নয় বলে মন্তব‌্য করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস‌্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এর মাধ‌্যমে সরকার বিএনপিকে চাপে রাখতে চাইলে ভুল করবে। কারণ, খালেদা জিয়া কোনো সাধারণ নেতা নন। তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, জনপ্রিয় নেত্রী। সেজন‌্য তাকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় হয়রানির বিষয়টি জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভালোভাবে নেবে না। সরকারের বিষয়টি বুঝতে হবে।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস‌্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, মামলা- এগুলো ষড়যন্ত্রেরই অংশ।’
এদিকে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার এবং এর প্রেক্ষিতে কৌশলগত অবস্থান নিতেও বেশ বিব্রত অবস্থায় দেখা গেছে বিএনপিকে। গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে জামায়াতের হরতাল শুরুর ৪ ঘণ্টা পর এতে সমর্থন দিয়েছে দলটি। জোটের নেতারা বিষয়টিকে বলছেন ‘সিদ্ধান্তহীনতা’।
২০ দলীয় জোটের এক শরিক নেতা বলেন,‘এখানে জোটের একটি দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেখানে বিএনপিসহ জোটের অবস্থান হতে হবে অত‌্যন্ত স্পষ্ট। কারণ, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রশ্নে হয়তো কৌশলগত অবস্থান নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু যখন রাজনৈতিক মিত্র গ্রেপ্তার হয়েছে তখন আপনাকে শক্ত অবস্থান নিয়ে বক্তব‌্য দিতেই হবে। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতা জোটের দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়।’
অন‌্যদিকে রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহে প্রধান বিচারপতির ছুটির বিষয়টি নিয়েও অস্বস্তিতে রয়েছে বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করছেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের মাধ‌্যমে সরকার যে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ছিলো, প্রধান বিচারপতিকে ‘ছুটিতে পাঠিয়ে’ তা সামাল দিয়েছে দলটি। তবে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর বিএনপির মধ্যে যে চনমনে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো, তা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না দলটির নেতারা। সরকারকে চাপে রাখতে এরই মধ‌্যে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের দ্বারস্থ হয়েছে দলটি। বুধবার বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি অবহিত করেছে বিএনপি।
বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে ‘অসুস্থ দেখিয়ে জোর করে’ ছুটিতে পাঠানো হয়েছে বলে বাংলাদেশে দায়িত্বরত বিদেশি কূটনীতিকদের বলেছে বিএনপি। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, কানাডা, সুইডেন, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, নরওয়ে, তুরস্ক, আরব আমিরাত, মরক্কো, ভিয়েতনাম, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ২৩ থেকে ২৪টি দেশের কূটনীতিকসহ জাতিসংঘের কর্মকর্তাও ছিলেন।
বৈঠকের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, ‘আমরা প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। আমরা মনে করি, তিনি অসুস্থ নন। তাকে যে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে সেটি বলেছি।’
বিএনপির অভিযোগ, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের কারণে ‘চাপ দিয়ে’ প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির ছুটির আবেদন উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের যে দরখাস্ত দেখিয়েছেন, তার সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি নেতারা। ওই চিঠিতে প্রধান বিচারপতির স্বাক্ষর ‘জাল’ করা হয়েছে বলে অভিযোগ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মওদুদের। খবর- রাইজিংবিডি ডটকম এর

আরও পড়ুন