জুম চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে পাহড়ি কৃষকরা

NewsDetails_01

পার্বত্যাঞ্চলে প্রতিবছর অনাবাদী থাকে সোয়া লাখ বিঘা পাহাড়ি ভূমি ॥ নিরাপত্তা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব

NewsDetails_03

Jhum Cultivation 1দেশের মোট ভূমির একটি বিশাল অংশ পার্বত্য এলাকায় থাকলেও পার্বত্য এলাকা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এখানে স্থানীয়ভাবে যে সামান্য রবিশস্য তথা ধান, গম আবাদ হয় তা এখানকার খাদ্য চাহিদার খুব সামান্যই পূরণ করতে পারে। এখানকার মানুষের বাকী খাদ্য চাহিদা মেটে বাইরের জেলা থেকে আসা খাদ্যের মাধ্যমে। এ প্রেক্ষাপটেও তিন পার্বত্য জেলায় প্রতি বছর প্রায় সোয়া লাখ বিঘা পাহাড়ি জমি অনাবাদি থাকে বলে কৃষি গবেষকগণ জানিয়েছেন।
পাহাড়ি এলাকায় হাজার হাজার একর আবাদযোগ্য জমিতে চাষাবাদ না হওয়ায় কৃষিপণ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে কৃষি বিষয়ক এক জরিপে জানানো হয়েছে। সূত্র অনুযায়ী, কৃষি ঋণ গ্রহনে জটিলতা, নিরাপত্তা, উপকরণের দু®প্রাপ্যতা এবং জমিতে মালিকানাস্বত্ত্বের অনিশ্চয়তার কারণে চাষীরা তাদের নিজ জমিসহ এসব আবাদযোগ্য পতিত ভূমিতে চাষাবাদ করতে পারছে না। ঋণ গ্রহণ করতে গিয়ে কৃষকরা নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে। তিন পার্বত্য জেলার কৃষকরা এনজিও অথবা ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে গিয়ে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে কৃষি উপকরণ সহজলভ্য না হওয়ায় ও পর্যাপ্ত কৃষিঋণের সুবিধা না পাওয়ায় পতিত ও অনাবাদী জমির পরিমাণ বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময় সরকারের ‘একটি খামার একটি বাড়ি’ প্রকল্পের সুবিধা পেয়ে কিছু কৃষক উপকৃত হলেও তারা অনাবাদি জমির প্রতি আগ্রহী হয়নি। পক্ষান্তরে পাহাড়ে উচ্চ ফলনশীল আম আম্রপলী, উন্নতজাতের লিচু ও আনারস চাষে এ ধরণের কিছু অনাবাদী জমির সদগতি হলেও, আড়তদারদের কাছ থেকে নেয়া দাদন, এনজিওদের চড়া সুদ এবং সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিকভাবে ভূমি নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে কৃষকরা এ বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী পার্বত্য তিন জেলায় এবারের শুমারিতে লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ষোল লাখের কাছাকাছি। বাংলাদেশের মোট ভূমির শতকরা ১০ ভাগ এলাকা নিয়ে পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান গঠিত। ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন পার্বত্য জেলায় ভূমির পরিমাণ ৯ লাখ ৩৯ হাজার ৯৮০ একর। এর মধ্যে খাগড়াছড়িতে এক লাখ ৪৫ হাজার ২৭১ দশমিক ৫৬ একর, রাঙামাটিতে চার লাখ ৩২ হাজার ৯৮০ একর এবং বান্দরবানে তিন লাখ ৬১ হাজার ১৬৯ দশমিক ৫৬ একর। পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ভূমির শতকরা ৬৬ ভাগ এলাকা বন যা সারা দেশের মোট বনের ৫০ ভাগের বেশি বনভূমি পার্বত্য এলাকায়। অবশিষ্ট ভূমির মাত্র ১৪ ভাগ জমি চাষের আওতায় আসে। এর মধ্যেও ৪.৫ শতাংশ জমি জলে ভাসা হওয়ায় এসব জমিতে বছরের এক মওসুমে চাষ করা যায়। ১৪ ভাগ জমির মধ্যেও জুমচাষের বিপরীতে বিরূপ প্রচার এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষদের শহুরে জীবন বা উন্নত জীবনের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় জুমচাষ আগের তুলনায় কমে গেছে। সাম্প্রদায়িক হানাহানির কারণেও জুমচাষে ভাটা পড়েছে বলে গ্রামীণ জনপ্রতিনিধিরা মত প্রকাশ করেছেন।
পার্বত্য তিন জেলায় আইনগত জটিলতার কারণে দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ভূমি বন্দোবস্তি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এ কারণেও পাহাড়ে পাহাড়ি-বাঙালি অনেক কৃষক তাদের ভোগদখলীয় জমিতে বন বাগান সৃজন করতে উৎসাহ পাচ্ছেনা। এতে ফলদ ও বন বাগানের পরিমাণও আশানুরূপ বাড়ছেনা।
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা তাওফিক হোসেন কবির জানান, নানা সমস্যার কারণে চাষাবাদের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ হারিয়ে যাওয়ায় পার্বত্য এলাকায় ক্রমেই অনাবাদী জমির পরিমাণ বাড়ছে। সনাতন পদ্ধতিতে অধিক খাটাখাটনি করে বিনিময়ে ভাল ফল না পাওয়ায় পাহাড়ি কৃষকদেরও জুম চাষের প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে আসায় পাহাড়ের বেশির ভাগ জমিই অনাবাদী পড়ে থাকছে।
এদিকে এলাকাবাসী বলছে কৃষি উপকরণ সহজলভ্য ও পর্যাপ্ত কৃষি ঋণের অভাবে কৃষকদের চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। তা ছাড়া পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা সনাতন পদ্ধতিতে জুমচাষে আশাব্যঞ্জক ফসল পাচ্ছে না। পর্যায়ক্রমে মাটি অনুর্বর ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৈরী আবহাওয়ার কারণে পাহাড়ি জুমের ফসল কমে আসছে। এ নিয়ে কৃষকদের মাঝে হতাশা আর খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর, কাউখালী, রাজস্থলী, বিলাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বাঘাইছড়ি এবং খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা, তবলছড়ি, মহালছড়ি ও দিঘিনালা উপজেলার বাঙালি কৃষকরা জানিয়েছে নিরাপত্তার অভাবে তাদের নিজস্ব জমিতেও কোন প্রকার কৃষিজ পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা জানান, যে কোন ফসল রোপণের সাথে সাথে এর জন্য একবার সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে হয়। উৎপাদিত পণ্য পরিপুষ্ট হওয়ার পর বাজারজাত করণের জন্য আর একবার চাঁদা দিতে হয়, সর্বশেষ বাজারে পণ্য বিক্রির সময় আরও একবার চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। বারবার এভাবে চাঁদা দিতে গিয়ে তাদের আর কিছুই থাকেনা। কৃষকরা সরকারিভাবে বন্দোবস্তি প্রাপ্ত জমিতে চাষাবাদ করতে গিয়ে নানাভাবে চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা। এভাবে নানা কারণে বছরের পর বছর আবাদযোগ্য ফসলী জমি পতিত থাকায় পাহাড়ে অনাবাদি জমির পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে কোন ধরণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে কার্ডের খয়রাতি সাহায্যের উপর একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে নির্ভর করে রাখায় তারা না করছে কোন কাজ না পারছে কার্ডের বিপরীতে দেওয়া খাদ্যে পরিবারের খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করতে। এতে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী খাদ্য সঙ্কটের সম্মুখীন হচ্ছে। দুই যুগ পূর্বে যে পরিবারকে একটি কার্ড প্রদান করা হয়েছিল এসব পরিবার এখন বেড়ে তিন/চার পরিবারে দাঁড়িয়েছে, মাস শেষে সরকারিভাবে দেয়া ৮৫ কেজি গম বা চালের রেশন এসব পরিবারকে আরো পিছিয়ে দিচ্ছে বলে মত প্রকাশ করেছেন অভিজ্ঞমহল। পাহাড়ে অনাবাদী উর্বর জমিগুলোতে জুম চাষের বিকল্প হিসেবে আধুনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন অর্থকরী ফসল চাষাবাদে আগ্রহী কৃষকরা। সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাগুলো কৃষকদের এ আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসলে, সেক্ষেত্রে যেমন অনাবাদী পতিত জমিগুলোর গতি হবে, তেমনি পাহাড়ের অর্থনীতিও শক্তি পাবে। তবে সবার আগে নিরাপত্তা ও সরকারি কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেছে ওয়াকিবহাল মহল।

আরও পড়ুন