নায়েক লিয়ান পুমহ্ বম। দেশের আদিবাসী বীরদের মধ্যে তিনিই হলেন বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি তিন পার্বত্য জেলা তথা দেশের একমাত্র বম সম্প্রদায় থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা। যার অসামান্য অবদানের কথা এসে যায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতা উল্টালেই।
১৯৯৩ সালে পার্বত্য বান্দরবানের বর্তমান রোয়াংছড়ি উপজেলার মিরামতিখুর পাড়ার সানহার বম ও তিস্নং সু বম এর ঘরে এই বীর সেনানি জন্মগ্রহন করেন। কৈশোর পেরিয়ে যুবক বয়সে ১৯৫৫ সালে তিনি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝড়া দিনগুলোতে দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেটসহ পাশ্ববর্তী এলাকায় কর্মরত ছিলেন। যার মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ গেজেট নং-৩৯৪০।
তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বম নৃ-গোষ্ঠীর আদি নিবাস মিয়ানমারের ইরাবতী, মিজুরাম ও চিন্দুইন নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় বলে ধারণা করা হয়। তবে বান্দরবানে সদরে বসবাসরত বম সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে আলাপকালে জানা যায়, তারা এদেশে প্রথমে ভারতের মিজোরাম থেকে এসেছে তারা। ইতিহাসবীদদের মতে, দেশের বম নৃ-গোষ্ঠীর আদি বসবাসস্থল ছিল চীনের চিনলুং পর্বতমালায়। পরবর্তীতে তারা মিয়ানমারে চলে আসে। বম নৃ-গোষ্ঠিরা মিয়ানমার থেকে এদেশে এসে আদিকাল থেকে বান্দরবানের রুমা ও থানছি উপজেলার দূর্গম পাহাড়ী এলাকাগুলোতে বসবাস শুরু করে। এরপর আস্তে আস্তে সদর উপজেলার চিম্বুক, কানাপাড়াসহ রোয়াংছড়ি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বসবাস শুরু করে এবং পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলাতেও বম নৃ-গোষ্ঠির বসবাস রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত ১১টি আদিবাসীর মধ্যে বম নৃ-গোষ্ঠী ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। ২০১১ সালে সরকারী আদম শুমারী অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের বম সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ১১,৬৩৭ জন। আর এই সম্প্রদায়ের মধ্যে নায়েক লিয়ান পুমহ্ বম দেশের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, লিয়ান পুমহ্ বম’কে ছোটবেলা থেকে সবাই আদর করে ডাকতো “পাকিক” বলে ডাকতো, পাহাড়ের ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির “বম” সম্প্রদায় থেকে দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বম সম্প্রদায়ের গর্ব তিনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী খ্রিষ্টান ধর্মানুসারী “বম” সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনিই একমাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য অবদান রাখতে পারার কারনে নিজ সম্প্রদায়ের এই মহান সেনানিকে সবাই মানতেন অত্যান্ত শ্রদ্ধার সাথে, স্বরণ করতেন উনাকে।
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার সংগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে অনেকে পাক বাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করলেও দেশ মাতৃকার টানে তিনি দেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহন করে। অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশের জন্য লাল সবুজের বিজয়ের পতাকা ছিনিয়ে এনে মুক্ত করেছিলেন দেশকে। মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনেকে সক্রিয় অংশগ্রহন করলেও তাদের অনেকের মতো লিয়ান পুমহ্ বম ছিলেন যেন নিভৃতিতে, নিরবে।
১৯৭১ সালে দেশের বম সম্প্রদায়ের বসবাস বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়িতে হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে তারা ছিল অন্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের তুলনায় কম। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের মিজোরামের মিজো বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অংশগ্রহন করলেও দেশের সংকটময় মূহুর্তে তিনি এগিয়ে আসেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৯৫৫ সালে তিনি যোগ দেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি সেকশন কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করে দিনাজপুর, ময়মনসিংহ,রংপুর ও সিলেটসহ পাশ্ববর্তী এলাকায় সক্রিয় ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। সেই সময় তার গুলি বর্ষনে পাক বাহিনীর অনেকে হতাহত হবার ঘটনা ঘটে।
স্বাধীনতার পর তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ রাইফেলস এ যোগ দেন এবং ১৯৭৯ সালে তিনি বর্ণাঢ্য এই কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহন করে। জেলা শহরের মধ্যম পাড়ায় তার পরিবারের সদস্যরা বসবাস করেন। মহান এই বীর যোদ্ধার দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে তন্ময় বম পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যোগদান করেন বিজিবিতে। ছোট ছেলে লিয়ান বম বান্দরবান জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে কর্মরত আছেন। স্ত্রী সিয়ান থেন বম এখনো বেঁচে আছেন। ২০১৪ সালের ২৬ মার্চ তিনি দীর্ঘ রোগ ভোগের পর মৃত্যুবরণ করেন। তাকে বান্দরবান জেলা শহরের ফাতিমা রাণী ধর্মপল্লিতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
তবে স্থানীয়দের অনেকে মনে করেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবে শুধু আদিবাসী হবার কারণে অনেকটা নজরের বাইরে থেকে যান পাহাড়বাসী এই বীর সেনানি। ফলে জীবিত থাকা কালে দেশের বম সম্প্রদায়ের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তার সম্মান এবং সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়নি যথাযথ ভাবে।