লামায় তামাকের আগ্রাসন

NewsDetails_01

বান্দরবানের লামায় বিদ্যালয়ের পাশে তামাক চাষ
বান্দরবানের লামা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে বিষবৃক্ষ তামাকের চাষ। কোম্পানীর পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে বীজ, ঋণে সার ও নগদ অর্থ দেওয়ার পাশাপাশি তামাক কেনার নিশ্চয়তা পেয়ে তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছেন চাষিরা। ফসলি জমি ছাড়াও তামাকের আগ্রাসন থেকে বাদ পড়েনি বিদ্যালয়ের মাঠ, লামা থানার ভূমি, বমু সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও মাতামুহুরী নদীর চর।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এক সময় ধান, ভুট্টা, আলু, বেগুন, লাউ, শিম, মুলা ও ফুলকপি,বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষাবাদের জন্য সুনাম ছিল লামা উপজেলার। কিন্তু এখন মাঠের পর মাঠ জুঁড়ে শুধু তামাকের ক্ষেত। বিকল্প না থাকায় তামাক চাষের দিকেই ঝুঁকে পড়ছেন চাষিরা।
আরো জানা গেছে, বিগত বছরগুলোতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরকারী জমিতে তামাক চাষ নির্মূল অভিযান পরিচালনা করা হলেও গত ২-৩ বছর ধরে তা হচ্ছেনা, ফলে দিন দিন তামাক চাষ বেড়ে চলেছে। আবার উৎপাদিত তামাক প্রক্রিয়াজাত করতে বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে দুই সহ¯্রাধিক তন্দুর (চুল্ল¬ী)। এসব চুল্লিতে জ্বালানী হিসেবে পোড়ানো হবে সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক বনের কাঠ। স্থানীয় এক শ্রেণীর বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই তামাক প্রক্রিয়াজাতকরনে লক্ষ লক্ষ মন কাঠ ব্যবহার করা হয়। ফলে দিন দিন বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে লামার বনাঞ্চল সমূহ।
লামা উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে লামায় তামাক চাষ হয়েছিল ৯৮০ হেক্টর জমিতে। চলতি বছর সাড়ে আটাশ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। তবে কৃষি অধিদপ্তরের দেওয়া এ তথ্য সঠিক নয় দাবী করে কৃষকরা জানান চলতি বছর দ্বিগুণ বেশি জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।
লামা পৌরসভা এলাকার ছাগলখাইয়া গ্রামের চাষি মোবারক হোসেন জানান, তামাক চাষের জন্য কোম্পানিগুলো অগ্রীম ঋণ হিসেবে সার ও নগদ টাকা দিচ্ছে। উৎপাদিত তামাক তারাই কিনে নেয়, তাই তারা তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছেন।
কৃষকরা জানিয়েছেন, ফসল চাষের শুরুতে কৃষকরা অর্থ সংকটে ভোগেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো চাষিদের মধ্যে কার্ড দিয়ে বিনামূল্যে বীজ সরবরাহ করে। সেই সঙ্গে কোনো শর্ত ছাড়াই ঋণে সার ও নগদ অর্থ দেয়। এরপর প্রতিটি কোম্পানির নিজস্ব সুপারভাইজাররা প্রতিনিয়ত চাষিদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেন। তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের উৎপাদিত তামাক কেনার শতভাগ নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। এসব লোভনীয় আশ্বাসে তামাক চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা।
রুপসীপাড়া ইউনিয়নের দরদরী গণমাস্টার পাড়ার চাষী শাহ্ আলম জানান, সবজি চাষে খরচের তুলনায় মুনাফা কম কিন্তু তামাক চাষে মুনাফা বেশি। আবার কোম্পানির টাকায় চাষাবাদ করা যায়, তাই দিন দিন তামাক চাষির সংখ্যা বাড়ছে।
তামাক চাষ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও অধিক মুনাফার আশায় নারীসহ পরিবারের সবাই সমানভাবে কাজ করছেন তামাক ক্ষেতে। এ কাজে অংশ নিচ্ছে শিশু কিশোররাও।
লামার ছাগলখাইয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্রী বিলকিছ আক্তার বলেন, প্রতিবছর তামাক বিক্রির টাকায় নতুন পোশাক কিনে দেন বাবা-মা। তাই তামাক পাতার গন্ধ ভালো না লাগলেও তামাক ক্ষেতে কাজ করি।
চাষিদের সুবিধার জন্য লামার বিভিন্ন স্থানে ঢাকা ট্যোবাকো , আবুল খায়ের ট্যোবাকো , নাসির ট্যোবাকো , আকিজ ট্যোবাকো ও বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ তামাক কোম্পানিগুলো গড়ে তুলেছেন বড় বড় ক্রয় কেন্দ্র ও গোডাউন। যেখানে চলে যায় কৃষকদের উৎপাদিত তামাক। চাষিদের যাবতীয় সমস্যার ব্যাপারে সর্বদাই সজাগ থাকছেন তামাক কোম্পানি সুপারভাইজার ও কর্মকর্তারা। এদিক থেকে পিছিয়ে পড়ছেন সরকারের কৃষি বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
লামা সদর ইউনিয়নের মেরাখোলা গ্রামের তামাক চাষি নজির আহমদ জানান, তামাক কোম্পানির কর্মীরা প্রতিদিন মাঠে গিয়ে তামাক চাষিদের সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। অন্যদিকে, সবজি ক্ষেত নষ্ট হলেও বেশিরভাগ সময় সরকারি কৃষি কার্যালয়ের লোকজনের পাওয়া যায় না।
আরো জানা গেছে, দিনভর তামাক ক্ষেতে কাজ করে নারী শ্রমিকরা মজুরি পায় মাত্র দেড়শ টাকা। বিকল্প কোন কর্মসংস্থান না থাকায় অল্প বেতনে তামাক ক্ষেতেই কাজ করতে হচ্ছে তাদের। তামাক পরিচর্যা করার সময় মাঝে মধ্যে পাতার বিষাক্ত গ্যাসে বমি বমি ভাব হয়, মাথা ঘুরায়, শ্বাস কষ্ট দেখা দেয়।
লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শফিউর রহমান মজুমদার জানিয়েছেন, তামাক শোধনের সময় নির্গত নিকোটিনের কারণে এলাকার লোকজন হাঁপানি, কাশি এবং ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূরে আলম বলেন, তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগ যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু চাষিরা অধিক মুনাফার আশায় তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। তবে কৃষকদেরকে তামাক চাষ থেকে ফেরাতে চলতি মৌসুমে বিকল্প সরিষা, ভুট্টা ও গম আবাদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি চাষ দেয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন