প্রবারণার আলোয় দূরিভুত হোক বিভিষিকার অন্ধকার

NewsDetails_01

আজ বৃহস্পতিবার। শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বিশ্বের সমস্ত বৌদ্ধরা আজ এই উৎসবটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করবে। তবে প্রবারণা পূর্নিমা তিথির আরেকটি নাম হল আশ্বিনী পূর্নিমা। এ উৎসবকে ঘিরে তিনমাস ব্যাপি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা পালন করেছেন বর্ষাব্রত। পূর্ণিমা, অমাবস্যা ও অষ্টমী তিথিতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নারী পুরুষরা পালন করেছেন অষ্টশীল। প্রবারণা বৌদ্ধ ধর্মীয় বিধানে বিনয় ভিত্তিক একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রতকর্ম ও অনুষ্ঠান। তবে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক হাজার হাজার রোহিঙ্গা নির্যাতন ও দেশ ত্যাগে বাধ্য করার কারনে এবারের প্রবারণা পূর্নিমা উদযাপনের কর্মসূচিতে একটু ব্যাতিক্রমতা রয়েছে। উৎসব উদযাপনে ফানুস উত্তোলনের পরিধি সংকোচিত করে কিছু অর্থ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রান হিসেবে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়াও বৌদ্ধদের বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের পাশে দাড়িয়েছে।
মহামতি গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে অবস্থানকালে তিনি ভিক্ষুসংঘের পালনীয় কর্তব্য হিসেবে এ প্রবারণার প্রবর্তন করেন। প্রবারণার দিন ভিক্ষুসংঘ সীমাঘর কিংবা বুদ্ধের সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রবারণার মন্ত্র উচ্চারণ করেন এবং বিনয়কর্ম সম্পাদন করেন। তারা এ বিনয়কর্মের মাধ্যমে ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান ভঙ্গ এবং সমাপ্ত করেন। ভিক্ষুসংঘ আপন আপন দোষত্রুটি স্বীকারপূর্বক অপর ভিক্ষুসংঘের কাছে প্রকাশ করে এবং তার প্রায়শ্চিত্ত বিধানের আহব্বান জানায়। তার পরদিন থেকেই শুরু হয় শুভ কঠিন চীবর দানোৎসব। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদের তিন মাস অধিষ্টিত ধ্যান ও জ্ঞান লাভের এ শিক্ষা গ্রামেগঞ্জে গিয়ে বৌদ্ধ সাধারণের কাছে প্রচার করেন।
বৌদ্ধ ধর্মীয় মতে, ভিক্ষু-শ্রামণ ও উপাসক-উপাসিকারা আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা- এই তিন মাস শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা সাধনার অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। এই তিন মাসে অষ্টমী, অমাবস্যা, পূর্ণিমা এবং ধ্যান, উপবাস ও সংযম শিক্ষার মধ্য দিয়েই তারা তাদের ব্রত অধিষ্ঠান শেষ করেন। তাই ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসব্রত অধিষ্ঠানের শেষ দিবসটিকেই বলা হয় বৌদ্ধ আভিধানিক শব্দে ‘প্রবারণা’। এটিকে বৌদ্ধ পরিভাষায় আশার তৃপ্তি বা অভিলাষ পূরণও বলা হয়। প্রবারণা পূর্নিমার পর দিন থেকে একমাস ব্যাপি বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার গুলোতে শুরু হয় কঠিন চিবর দান অনুষ্ঠান। মূলত; এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনমাস ব্যাপি যে ভিক্ষু উক্ত বিহারে বর্ষাবাস যাপন করেছেন তাঁকে আনুষ্ঠানিক ভাবে একটি চিবর দান দ্ওেয়া এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মহামানব গৌতম বুদ্ধের পবিত্রবানীর আলোকে আলোকপাত করা। কঠিন চিবরদান অনুষ্ঠানকে ঘিরে প্রতিটি গ্রামে আত্মীয় সম্মেলন বা জ্ঞাতি সম্মেলনও হয়ে উঠে। গ্রামবাসিরা বাড়ির আশপাশ পরিস্কারসহ সবাই একত্রিত হয়ে গ্রামকে এবং বিহারকে নানা ভাবে সাজিয়ে তোলে।
এদিকে প্রবারনা পূর্নিমা উদযাপনের লক্ষ্যে রাজধানীর মেরুল ব্ড্ডাা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে বাংলাদেশ বুদ্ধিষ্ট ফেডারেশন, এবং কমলাপুর ধর্মরাজিক মহাবিহারে বাংলাদেশ কৃষ্টি প্রচার সংঘ গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহন করেছে। কর্মসূচি গুলোর মধ্যে রয়েছে বুদ্ধ পতাকা উত্তোলন, বুদ্ধ পুজা,জগতের সকল প্রাণীর সুখ ও মঙ্গল কামনায় সমবেত প্রার্থনা, ভিক্ষু সংঘকে পিন্ডদান,প্রবারণা পূর্ণিমার তাৎপর্য শীর্ষক আলোচনা। সন্ধ্যায় হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও পঞ্চশীল গ্রহন এবং ফানুস উত্তোলন। বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চল বলে খ্যাত বান্দরবান,রাঙামাটি, খাগড়াছড়িতে এবার ষাড়ম্বরে উদযাপিত হচ্ছে প্রবারণা পূর্নিমা ও ফানুস উৎসব। সকালে বান্দরবানের রাজারমাঠে রথযাত্রা উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে শুরু হবে এ অনুষ্ঠান।
মূলত বৌদ্ধধর্ম হল আচরনের ধর্ম। কর্মবাদি ধর্ম বা কর্ম ও কর্ম ফলের উপর বিশ্বাস করা। বৌদ্ধধর্ম শীল-সমাধি-প্রজ্ঞা নির্ভরশীল ধর্ম। তাই জীবনের সব ক্ষেত্রে জ্ঞান ,প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা অপরিহার্য। কারন লোভ, দ্বেষ,মোহ এক কথায় অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা, মূর্খতা ও অসৎকর্ম মানবজীবনে কখনও সুখ আনয়ন করতে পারে না। কখনও মানুষকে বড় করতে পারে না। যার ফলশ্রুতিতে দেশ ও সমাজ সমৃদ্ধ হয় না। কারণ, অন্ধকার দিয়ে যেমন আলোকে আহব্বান করা যায় না, তেমনি অকুশল ও মন্দকর্ম দিয়ে কখনও সৎ, শুভ ও কল্যাণকে আহব্বান করা যায় না। তাই প্রবারণার দিনে সবার প্রতি আহব্বান জানাই মহামানব গৌতম বুদ্ধের অমৃত বাণী, জ্ঞান দর্শন ধারণ করে প্রবারণার শিক্ষা গ্রহনপূর্বক দেশ, জাতি ও সমাজ বিনির্মানে দলমত, জাতি গোষ্টি, সম্প্রদায়ের বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করি। জগতের সবার জয়মঙ্গল হউক।

NewsDetails_03

লেখক:
নিবারণ বড়ুয়া, কর্মকর্তা ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক।

আরও পড়ুন