বান্দরবানের ৮টি সিনেমা হলের মধ্যে রইলো বাকি ১টি

NewsDetails_01

বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দেয়া বান্দরবানের সুরবিতান সিনেমা হল
বান্দরবানের প্রায় ১০ লাখ মানুষের কাছে সিনেমা হল যেন এক সুদূর অতীত। উপচে পড়া ভিড়ে মুখরিত বান্দরবান সদর, লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় স্থাপিত এক সময়ের আলোচিত বিলাস বহুল ৮টি সিনেমা হলের মধ্যে এখন ৭টিই বন্ধ, ফলে পর্যটন নগরীর স্থানীয়রা বিনোদন বঞ্চিত হচ্ছে।
আবহমানকাল ধরে বাঙালির অন্যতম বিনোদন মাধ্যম সিনেমা হল। এক সময় সুযোগ পেলে পরিবার, বন্ধু স্বজনদের নিয়ে দেখতে যেতেন সিনেমা হলে। সিনেমা দেখেই তাদের মনের খোরাক মেটাতো। সেদিনের সিনেমার গল্পের বুনন এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, সিনেমা মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যেত। আবার প্রেক্ষাগৃহের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে, কখনো আবার কালোবাজারির হাত থেকে দ্বিগুণ দামে টিকিট কেটে চলচ্চিত্র উপভোগ করা খুবই সাধারণ বিষয় ছিল। জেলায় দর্শক শূণ্যতায় হলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে সেখানে গড়ে উঠছে মার্কেট, দোকান ও বসতবাড়ি। আবার চালুকৃত সিনেমা হলটিতে যে দর্শক তাতে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে হলটি। বর্তমান ডিজিটাল যুগে বান্দরবানের কোন উপজেলায় চিত্তবিনোদনের কোন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আশির দশকের দিকে বান্দরবানের লামায় ৪টি, আলীকদমে ১টি, নাইক্ষ্যংছড়িতে ১টি ও বান্দরবান সদরে ২টি সিনেমা হল স্থাপিত হয়। নব্বই দশকেও এসব সিনেমা হলগুলো সগৌরবে চলছিল। হলগুলোতে সিনেমা দেখতে দীর্ঘ লাইন দিয়ে টিকেট কাটতে হত। কোনো সিনেমা ভালো লাগলে কেউ কেউ দু’তিন বারও দেখতো। ২০০০ সালের দিকে হলগুলির সামনে দিন দিন দর্শকের দেখা কমতে থাকে। ফলে একে একে বন্ধ হতে থাকে সিনেমা হলগুলো।
আরো জানা গেছে, দেশের নিন্মমানের চলচিত্র নির্মান, বাস্তব জীবনের গল্প অবলম্বনে তৈরী না হওয়ার কারনে দর্শকরা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ২০০৫ সালে বন্ধ হয়ে যায় আলীকদম উপজেলার পর্বত সিনেমা হল, ২০০৯ সালে লামা উপজেলার বনফুল সিনেমা হল, ২০০১ সালে কুমারীর বনগিরি সিনেমা হল, ২০১০ সালে আজিজনগরের ছবিঘর সিনেমা হল, ২০০২ সালে নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়িকা সিনেমা হল ও সর্বশেষ ২০১৬ সালে বন্ধ হয়ে যায় বান্দরবান সদরের বনশ্রী সিনেমা হলসহ ২টি।
বর্তমানে লামার আজিজনগরের সুর বিতান সিনেমা হল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এর মধ্যে আবার নিয়মিত সবকটি শোও চলছে না হলে। মাঝে মধ্যে বন্ধ থাকে এ সিনেমা হলটি। সুরবিতান সিনেমা হলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চলছে ‘বাংলার বাঘ’ নামের একটি সিনেমা। বিকেলের শো’তে ডিসি ও রিয়ার স্টল মিলে ৭৫০টি আসন থাকলেও মাত্র ৮ জন দর্শক উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে ১২০ টাকা মূল্যের ‘ডিসি’তে ২৫০টি আসনের বিপরীতে দর্শক ছিলেন ২জন। আর ‘রিয়ার স্টলে’ ৫০০টি আসনের বিপরীতে দর্শক ছিলেন ৬জন।
এই ব্যাপারে হলের তত্ত¡াবধায়ক সাব্বির আহমদ বলেন, আগে বিনোদনের তেমন ব্যবস্থা ছিল না, এতো চ্যানেল ছিল না। এখন নতুন নতুন হিন্দী ছবি চ্যানেলে দেখাচ্ছে। ঘরে বসে প্রাইভেট চ্যানেলে হিন্দী বাংলা ছবি দেখা যাচ্ছে, অথচ হলে দেখা যাচ্ছে না। কেন মানুষ হলে এসে সিনেমা দেখবে?
গবেষকদের মতে, মানুষ এখন টিভি ও সিডির মাধ্যমে মানুষ সিনেমা দেখে। বেশ কয়েক বছর যাবৎ সুস্থ চলচ্চিত্র নির্মিত না হওয়ায় মানুষ ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে সিনেমা হলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। তবে ভাল মানের সিনেমা ও উপযুক্ত পরিবেশ হলে আবারও মানুষকে হলমুখী করা যাবে বলে মনে করেন তারা।
সিনেমা হলের ব্যবসায় মন্দা ভাবের নেপথ্যের কারণ কী? এই ব্যাপারে বান্দরবান শহরের তরুণ আরাফাত হোসেন বলেন, সিনেমা হলে যাওয়ার পরিবেশ নেই, ভালো মানের ছবি নেই, সব নকল ছবি,ছবির কাহিনী কোন ভাবে আর দর্শকদের নাড়া দেয়না।
হল মালিকরা বলছেন, সিনেমা হল চালাতে যা ব্যয় হয়, তার একাংশও উঠে না। অন্যদিকে চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রযোজক, পরিবেশকদের অভিযোগ আকাশ সংস্কৃতির সহজ লভ্যতা ও হল মালিকদের অসহযোগিতা চলচ্চিত্র শিল্পের দুর্দিনের কারণ। সমাধানের জন্য সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে বলে অভিমত চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের।
লামা বনফুল সিনেমা হলের মালিক মো. ইউছুপ আলী ও তৈয়ব আলী বলেন, একসময় বান্দরবান সদরসহ লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি তিন উপজেলায় ৮টি সিনেমা হল চালু ছিল। এসব সিনেমা হলগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণেই রমরমা ব্যবসা হতো। অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু মানুষ স্যাটেলাইট চ্যানেল গুলোর সুবাদে মানুষের সিনেমা হলে যাওয়া কমে যায়। এতে দর্শক সংকটের কারণে বিদ্যুৎ বিল কর্মচারিদের বেতন ভাতা পর্যন্ত তোলা যায় না। এতে করে একে একে হলগুলি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই।
এদিকে একে একে হল বন্ধ হবার কারনে সিনেমা হলের শত শত কর্মচারী বেকার হয়ে পড়ে। অনেকে পেশা ত্যাগ করে ফিরে গেছেন অন্য পেশায়। প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে রুচিসম্মত সিনেমা তৈরী জন্য নির্মাতাদের উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার দাবী জানিয়েছেন হল মালিকরা।

আরও পড়ুন