আলিকদমে প্রতিনিয়ত বাড়ছে জুম চাষ

NewsDetails_01

অবৈজ্ঞানিক পদ্বতিতে জুম চাষে বিপন্ন পাহাড়ি প্রকৃতি

পার্বত্য বান্দরবানের আলীকদমে প্রিতিনিয়তই বাড়ছে জুম চাষ। প্রকৃতি হরাচ্ছে তার ভারসাম্য, নদী হারাচ্ছে নাব্যতা। প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুমচাষ। যার কারণে পাহাড়গুলো হয়ে পড়ছে বৃক্ষশুণ্য। মাটি হারাচ্ছে উর্ভরতা। সেই সাথে পাহাড় ধ্বসে মাটি এসে ভরাট হচ্ছে নদী। কাসাভা আলু, হলুদ, আদা ও কচু চাষের কারণে মাটির ক্ষয় হচ্ছে। ধস নামছে পাহাড়ে। এবিষয়ে পরিবেশবিধদের আশংকা, এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়গুলো বিলীন হয়ে যাবে। পাহাড় রক্ষায় এখনই সরকারের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা বংশ পরম্পরায় পাহাড়ে অবৈজ্ঞানিক ও আদিম পদ্ধতিতে এই জুম চাষ করে আসছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিবছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে পাহাড় বা টিলা বেছে নিয়ে জুম চাষের জন্য বন জঙ্গল কেটে সাফ করে আদিবাসীরা। মার্চে রোদে শুকানোর পর এপ্রিলে আগুনে পোড়ানো হয় এসব বনজঙ্গল। পরে বৃষ্টি এলে পুরো পাহাড়ের গায়ে গর্ত করে রোপণ করা হয় ধান, তুলা, তিল, তামাক, ভুট্টাসহ বিভিন্ন শাক-সবজির বীজ। যার ফলে পাহাড়ে উদ্ভিদ বলতে কোন কিছুই থাকেনা এবং আগুনে পোড়ানোর পর বৃষ্টির পানি পড়লে পাহাড়ের মাটি ক্ষয়ে নদীগুলোতে নেমে এসে নদী ভরাট হয়ে যায়।

মৃত্তিকা বিশেষজ্ঞরা বলেন, মার্চের প্রচন্ড গরমে বনজঙ্গল কেটে ফেলা পাহাড়গুলোর মাটি শুকিয়ে ইট হয়ে যায়। এতে ছোট বড় পাহাড় ও টিলাগুলোতে ফাটল সৃষ্টি হয়। ফাটলে বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হয়ে ভয়াবহ আকারে পাহাড় ধস শুরু হয়। ভূমি অবক্ষয় পরিবীক্ষণ সম্পর্কিত টাস্কফোর্স পরিচালিত এক জরিপের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে প্রায় ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি ক্ষয়ের মুখে। অপরিকল্পিত চাষাবাদ, বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে আদি পদ্বাতির জুম চাষকে এ ভূমি ক্ষয়ের কারণ হিসাবে উল্যেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পার্বত্য এলাকার পাহাড়গুলোতে চাষাবাদ অব্যাহত থাকলে পাহাড় ধ্বস ও ক্ষয়ের কারণে আগামী ২০-২৫ বছর পর এখানকার পাহাড়গুলো নামে মাত্র দৃশ্যমান থাকবে। তিনি বলেন, এ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে পাহাড় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন করে পাহাড়ের চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এছাড়া পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তা চাষিদের কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে।

NewsDetails_03

এদিকে পাহাড়ে চাষাবাদের জন্য এ পর্যন্ত দুটি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হলেও তা এ পার্বত্য এলাকায় তেমন কার্যকর করা যায়নি। সুত্র জানায়, ১৯৯০ সালের দিকে নেপালের আন্তর্জাতিক পার্বত্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র এবং খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের যৌথ গবেষণায় (সল্ট) নামে পাহাড়ে চাষাবাদের একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়। কিন্তু এ প্রযুক্তি চাষিদের মাঝে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। পরবর্তীতে ২০০১ সালে রামগড় পাহাড় অঞ্চল কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানিরা মডার্ন এগ্রিকালচারাল টেকনলজি ইন দ্যা হিলস্ (ম্যাথ) নামে আরেকটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। এ প্রযুক্তির ব্যবহার এখনও চাষি পর্যায়ে পৌঁছেনি।

১৯৯২ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরে প্রতি হেক্টর পাহাড়ি জমিতে ১০০ হতে ১২০ টন পর্যন্ত মাটি ক্ষয় হচ্ছে। এ প্রতিবেদনে পার্বত্যাঞ্চলে ভুমি ক্ষয়ের হারকে আশংকাজনক বলে উল্যেখ করা হয়েছে। এছাড়া আইইসিএন নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে মৃত্তিকা সম্পদের ১৮ ভাগ ক্ষতি সাধন হয়েছে। অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাহাড়ে চাষাবাদকে এর জন্য দায়ী করা হয়। এদিকে, গত কয়েক দশক সময় ধরে পার্বত্য এলাকায় ছোট, বড় ও মাঝারি সব ধরনের পাহাড় ও টিলায় অপরিকল্পিতভাবে কাসাভা আলু, কচু, হলুদ ও আদা চাষাবাদ হচ্ছে। পাহাড়ের মাটি খুঁড়ে এসবের ব্যাপক চাষাবাদের কারণেও পাহাড়গুলো মারত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

জানা যায়, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে অবস্থিত ৫৪৮০ বর্গকিলোমিটার অশ্রেণীভুক্ত বনভূমির সিংহভাগ এবং ৩১৭২ বর্গকিলোমিটার সংরক্ষিত বনভূমির কিছু অংশেও জুম চাষ এবং কাসাভা আলু, হলুদ, কচু ও আদার চাষ হয়। কাসাভা আলু, হলুদ,আদা, কচু ইত্যাদি চাষাবাদ জুম চাষের চেয়েও অধিক ক্ষতিকর। এসব লাগানোর সময় একবার এবং ফসল উঠানোর সময় আরেকবার পাহাড় ও টিলার মাটি কুপিয়ে উপড়ে ফেলা হয়।

কাসাভার গাছের মূলই আলু হিসাবে ব্যবহার হয়। মাটির অনেক গভীরে থাকা এ মূল তোলার জন্য টিলার মাটি কোদাল দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়। হলুদ, আদা ও কচু তোলার জন্যও একইভাবে বারবার খোঁড়াখুঁড়ির কারণে পুরো টিলার মাটিই আলগা হয়ে পড়ে। বর্ষার সময় অল্প বৃষ্টি হলেই আলগা মাটিগুলো ধুয়ে যায়। এতে মাটির উপরের অংশে থাকা টপ সয়েল বা উর্বর মাটির স্তরও পানির তোড়ে ভেসে যায়। এ টপ সয়েল ক্ষয়ের কারণে ঐ পাহাড় বা টিলাগুলো অনুর্বর হয়ে পড়ায় কোন ফসল ফলে না।

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে তিন পার্বত্য জেলার শত শত পাহাড় টিলা ধসে পড়ছে। এতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। অন্যদিকে পাহাড় ধ্বস ও মাটি ক্ষয়ের কারণে পাহাড়ের পাদদেশে প্রবাহিত ছড়া, খাল ও নদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন